
কিছু তারিখ আছে, যা শাসক ভুলিয়ে দিতে চায়, কিন্তু শাসিত ভোলে না। বছর ঘুরে ভুক্তভোগীর হৃদয়ভাঙা স্মৃতি নিয়ে তারিখটি ফিরে আসে।
শাসিত সেই স্মৃতির দিকে চেয়ে ডুকরে ওঠে। শাসক বলে, পেছনে ফিরে কী লাভ? বাদ দাও; সামনে তাকাও।
দেশ হারানো বাংলাভাষী মানুষের কাছে তেমনই একটি তারিখ ২৬ জানুয়ারি। এই তারিখ মনে করিয়ে দেয় কুখ্যাত দণ্ডকারণ্যের নির্বাসনদণ্ড থেকে মরিচঝাঁপির গণহত্যার কথা।
এই ২৬ জানুয়ারিতে প্রোথিত আছে ইতিহাসের এমন এক নির্মম অধ্যায়, যা আজও চেপে রাখার চেষ্টা চলছে। ১৯৭৯ সালের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলের মরিচঝাঁপি দ্বীপে ১৪৪ ধারা জারি করে চালানো হত্যাকাণ্ড উদ্বাস্তু মানুষের জীবনে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়ে গেছে।
আজ ইতিহাসের সেই দিনে একবার ফিরে তাকানো যাক।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর হাজার হাজার দলিত ও নিম্নবর্ণের হিন্দু উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান, তথা আজকের বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যান।
তাঁদের মধ্যে অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু এই উদ্বাস্তুদের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার সাদরে গ্রহণ করেনি।
পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়াকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে নিয়েছিল কংগ্রেস সরকার।
রামায়ণের কাহিনিতে রাম-সীতা-লক্ষ্মণের বনবাসকাল কেটেছিল যে দণ্ডকারণ্যে, বিংশ শতকে হাজার হাজার গরিব ও নিম্নবর্গের বাঙালি উদ্বাস্তুকে সেই দণ্ডকারণ্যে আক্ষরিক অর্থে বনবাসে পাঠানো হয়েছিল।
আজকের ভারতের ছত্তিশগড়, ওডিশা, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার বিস্তৃত বিশাল জঙ্গলাকীর্ণ দণ্ডকারণ্যে পশুর মতো জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল তাঁদের।
‘উদ্বাস্তুবান্ধব’ জ্যোতি বসুর বাম দল একসময় শরণার্থীদের কাছে আশার আলো হয়ে ধরা দিয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ভিলাইয়ে এক জনসভায় জ্যোতি বসু নিজে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্য থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
সিপিএম ক্ষমতায় আসার বছরখানেক আগে সিপিএম নেতা রাম চট্টোপাধ্যায়সহ কয়েকজনকে দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে এসব উদ্বাস্তুকে পশ্চিমবঙ্গ ফেরার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের ৫ কোটি বাঙালি ১০ কোটি হাত তুলে তাঁদের স্বাগত জানাবে।
এরপর ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বাম ফ্রন্ট ক্ষমতায় এল। খুশি হলেন উদ্বাস্তুরা। এবার তাঁরা ফিরতে পারবেন এমন জায়গায়, যেখানে মানুষ তাঁদের মতো বাংলায় কথা বলে।
১৯৭৮ সালের মার্চ নাগাদ সহায়–সম্বল সব বিক্রি করে দণ্ডকারণ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে রওনা হন দেড় লাখ শরণার্থী।
কিন্তু এখন দেখা গেল, নির্বাচনের আগের বাম ফ্রন্ট আর ক্ষমতাসীন বাম ফ্রন্টের কথাবার্তায় মিল নেই। বাম ফ্রন্টের নেতারা বলতে লাগলেন, ফেরা যাবে না।
বাম নেতাদের কথা শুনে অনেক আগেই উদ্বাস্তু সমিতি খোঁজখবর নিয়ে বসত গড়ার জন্য পছন্দ করে এসেছিল মরিচঝাঁপি দ্বীপটিকে।
এটি কলকাতা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের লাগোয়া ১২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দ্বীপ। ১৯৭৮–এর শেষ নাগাদ সেখানে ঠাঁই নিলেন ৩০ হাজার মানুষ।
ক্ষমতায় গিয়েই বাম সরকার ভুলে গেল প্রতিশ্রুতি। লাখখানেক উদ্বাস্তুকে তারা ফেরত পাঠাল দণ্ডকারণ্যে। কিন্তু হাজার চল্লিশেক শরণার্থী রয়ে গেলেন।
সাত মাসের পরিশ্রমে ফসল ফলালেন তাঁরা। আবাদি জমিতে ফসল ফলানোর পাশাপাশি মাছের চাষ শুরু করলেন তাঁরা। নিজেরাই সেখানে গড়ে তুললেন জনপদ।
এর মধ্যেই নির্দেশ এল, মরিচঝাঁপি ছাড়তে হবে।
সরকার বলল, এঁরা সুন্দরবনের পরিবেশ নষ্ট করছেন, বাঘের অভয়ারণ্য এঁদের কারণে বিপন্ন! অথচ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মানচিত্রে মরিচঝাঁপির ওই জায়গা অন্তর্ভুক্তই ছিল না।
১৯৭৮–এর ১ জুলাই সিপিএমের রাজ্য কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হলো, উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করা হবে।
১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় উৎখাতের প্রথম পর্যায়। ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় অবরোধ। ৩০টি লঞ্চ অধিগ্রহণ করে মরিচঝাঁপিকে ঘিরে ফেলে রাজ্য সরকারের পুলিশ।
২৬ জানুয়ারি সেখানে ১৪৪ ধারা জারি হয়। সংবাদমাধ্যমের লোকজনকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শরণার্থীদের টিউবওয়েল থেকে শুরু করে ফসলের জমি, মাছের ঘের, নৌকা সব নষ্ট করে ফেলা হয়।
এই ঘটনা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি তদন্ত হয়েছে বলে জানা যায়নি। যা কিছু তথ্য বা ভাষ্য আছে, তা আছে বেসরকারি অনুসন্ধানে আর টুকটাক সাহিত্যকর্মে। মরিচঝাঁপি নিয়ে শঙ্খ ঘোষ ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতা লিখেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও মরিচঝাঁপির মানুষের দুর্দশার কথা লিখেছেন।
যে বৃষ্টির পানি ধরে তাঁরা খেতেন, সেই পানিতে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। বিষাক্ত পানি খেয়ে অনেক শিশু মারা যায়। বাইরে থেকে খাবার আনার উপায় ছিল না। একসময় খাবার ফুরিয়ে যায়।
শিশু, বৃদ্ধের ক্ষুধার যন্ত্রণা দেখে সহ্য করতে না পেরে ৩১ জানুয়ারি কিছু মরিয়া যুবক পাশের কুমিরমারী থেকে খাবার আনতে সাঁতরে ব্যারিকেড ভাঙতে গেলে পুলিশ তাঁদের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে মারা যান অন্তত ৩৬ জন।
এরপর মাস তিনেকের বিরাম দিয়ে মে মাসের শুরুতে মরিচঝাঁপি অধ্যায় একেবারের শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। পুলিশের হাত শক্ত করতে যোগ দেয় সিপিএম ক্যাডাররা।
১৩ মে মরিচঝাঁপিতে গভীর রাত থেকে শুরু হয় এক নৃশংসতা। টানা তিন দিন চলে আক্রমণ। অনেকের মতে, পার্টির গুন্ডারা ঘরে ঘরে আগুন দিয়েছিল, বহু মানুষ খুন করেছিল।
অনেক নারীকে তারা ধর্ষণ করেছিল। আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল অনেক শিশু। দুঃস্বপ্নের একাত্তরই যেন ফিরে এসেছিল তাদের কাছে।
অবশেষে আক্ষরিক অর্থে সাফ হয়ে যায় মরিচঝাঁপি। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে হতাহতের সংখ্যা আজও অজানা। কারও মতে, কয়েক শ মানুষ মরেছে। কারও মতে, হাজার মানুষ।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হিসাব অনুসারে, ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু অবরোধ ১৩ মে পর্যন্ত মরিচঝাঁপিতে অনাহারে ৯৪ জন এবং বিনা চিকিৎসায় ১৭৭ জন শিশু মারা গেছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৪ জন নারী। মারা গেছেন কমপক্ষে ২৩৯ জন। নিখোঁজ হয়েছেন ১২৮ জন। অন্যান্য সূত্রের দাবি, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
এই ঘটনা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি তদন্ত হয়েছে বলে জানা যায়নি। যা কিছু তথ্য বা ভাষ্য আছে, তা আছে বেসরকারি অনুসন্ধানে আর টুকটাক সাহিত্যকর্মে।
মরিচঝাঁপি নিয়ে শঙ্খ ঘোষ ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতা লিখেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও মরিচঝাঁপির মানুষের দুর্দশার কথা লিখেছেন।
কিন্তু এই নির্মম গণহত্যার খবরটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে যথাযথভাবে প্রচার পায়নি। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার বরাবরই বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইতিহাস কি চেপে রাখা যায়?
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক