
আফগানিস্তানের নারীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যে প্রধান গল্পটি বারবার উঠে আসে, তা মূলত বিধিনিষেধ, বঞ্চনা ও অধিকার হারানোর কাহিনি। তালেবানের ইসলামি আমিরাতের শাসনে নারীদের অধিকার চরম হুমকির মুখে। এটিই সম্ভবত সেই প্রধান কারণগুলোর একটি, যার জন্য তালেবানের শাসনব্যবস্থা এখনো ব্যাপক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি।
তবে প্রায়ই যে বিষয় চোখ এড়িয়ে যায়, তা হলো আফগান নারীদের সাহস, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ও দৃঢ়তার গল্প। কঠিন কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাঁরা পরিবর্তন আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুটা হলেও বাস্তবতা হিসেবে বিষয়টি স্বীকার করে নিচ্ছে তালেবানের বাস্তব কর্তৃপক্ষও।
ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নতির কোনো আশা রাখতে হলে এসব সম্ভাবনার জানালা চিহ্নিত করা জরুরি এবং আফগানিস্তানের ভেতরে থাকা নারীদের সেই উদ্যোগ ও সক্ষমতার ওপর ভর করেই এগোতে হবে, যাঁরা অত্যন্ত জটিল বাস্তবতার মধ্যে পথ খুঁজে নিচ্ছেন। এ ধরনের আশার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হলো আফগানিস্তান উইমেন্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা এডব্লিউসিসিআই। এটি ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ছিল আফগান নারী উদ্যোক্তা ও তাঁদের ব্যবসাকে উৎসাহ দেওয়া ও সহায়তা করা। নারীদের উদ্যোক্তাদের একটি সম্মিলিত কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করা, তাঁদের সুযোগের সঙ্গে যুক্ত করা এবং সংকুচিত অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সময় ধীরে ধীরে আরও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
তালেবান সরকারের অধীনও এডব্লিউসিসিআই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং তা ২০টি প্রদেশে বিস্তৃত হয়েছে। এর ফলাফল নীরব এক বিপ্লবের মতো, যার মাধ্যমে নারী ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২০ সালে প্রায় ২ হাজার ৪২১ জন আফগান নারী ব্যবসায়ীর সরকারি লাইসেন্স ছিল এবং তাঁরা এডব্লিউসিসিআইয়ের সদস্য ছিলেন। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা প্রায় চার গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ১৬২ জনে। বর্তমানে সারা দেশে নারীদের মালিকানাধীন নিবন্ধিত ব্যবসার সংখ্যা ১১ হাজার ৬২৫। লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করা নারীর আনুমানিক সংখ্যা ৫২ হাজার থেকে বেড়ে ১ লাখ ২০ হাজারে পৌঁছেছে। এসব ব্যবসা তুলনামূলকভাবে সীমিত হলেও এর বেশির ভাগই হস্তশিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিল্প ও অলংকার তৈরির সঙ্গে যুক্ত।
আফগানিস্তান সফরের সময় আমি এডব্লিউসিসিআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই। তিনি সংস্থাটির বিস্তৃত দায়িত্ব ও অর্জনের কথা জানান। গত দুই বছরে এডব্লিউসিসিআই ১২ হাজার ৫০০টির বেশি ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে বিকল্প বাণিজ্যপথ ব্যবহারে সহায়তা করেছে। ৯০০টির বেশি নারী মালিকানাধীন ব্যবসাকে ডিজিটাল বাণিজ্য ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছে। সারা আফগানিস্তানে পাঁচ হাজারের বেশি নারীকে আর্থিক শিক্ষা ও ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পাশাপাশি সরবরাহব্যবস্থা শক্তিশালী করতে ১০টির বেশি আঞ্চলিক বাজারের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছে। যেসব নারী জনসমক্ষে কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তাঁদের জন্য এডব্লিউসিসিআই ঘরে বসে অনলাইনে ব্যবসা করার একটি উদ্যোগ চালু করেছে। তালেবান কর্মকর্তারাও এই উদ্যোগকে নারীদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ও উপকারী বলে উল্লেখ করেছেন।
এই অর্জনগুলো আফগান নারীদের অসাধারণ দৃঢ়তা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের পরিবর্তন আনার সক্ষমতাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
চ্যালেঞ্জের কোনো অভাব নেই। নারীদের লক্ষ্য করে তালেবানের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞাগুলোর মধ্যে রয়েছে নারী লেখকদের লেখা ৬০০টির বেশি বই শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার থেকে নিষিদ্ধ করা। এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা আফগানিস্তানে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক ও ওয়াই–ফাই সেবা নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেন। তাঁর দাবি ছিল, এটি অনৈতিকতা রোধের জন্য। বিশেষ করে বলখ, কান্দাহার, উরুজগান, জাবুল ও নিমরুজ প্রদেশে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়। তবে আফগান নারীদের অর্জন প্রমাণ করে, তাঁরা এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও পথ খুঁজে নিতে সক্ষম এবং ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গা পুনরুদ্ধার করছেন। বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবিকা নির্বাহের নানা উপায় তাঁরা খুঁজে বের করছেন এবং গড়ে তুলছেন।
দেশে এমন আরও অনেক ছোট সংগঠন রয়েছে, যারা নারীদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসব উদ্যোগের কথা খুব কমই উঠে আসে।
নিয়ন্ত্রণমূলক পরিবেশ যেমন বাস্তব, তেমনি বাস্তব হলো আফগান নারীদের দৃঢ়তা ও উদ্ভাবনী শক্তির নানা উদাহরণ। দেশের ভেতরে থাকা আফগানদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এসব উদ্যোগ সংরক্ষণ ও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। ছোট ছোট উদ্যোগও বাস্তব ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। তালেবান–শাসিত আফগানিস্তানের কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই সুযোগের এসব জানালা খুঁজে বের করা জরুরি এবং দেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণে নারী ও সাধারণ মানুষের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকেই আসতে পারে। আজ যেসব বাধা অটুট বলে মনে হয়, সেগুলো ভেঙে দিয়েই সেই পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
ড. শান্তি মারিয়েট ডি’সুজা মন্ত্রয়া ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষক
দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত