জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলাতেও জেলাভিত্তিক সক্ষম মানুষের সংখ্যায় আছে অনেক তারতম্য।
জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলাতেও জেলাভিত্তিক সক্ষম মানুষের সংখ্যায় আছে অনেক তারতম্য।

মতামত

সব উন্নয়ন কর্মসূচিতে গুরুত্ব পাক জলবায়ুবিপন্নতা

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় পরিবেশ ও নদী নিয়ে কাজের সুবাদে নিয়মিত যাওয়া হয়। খুব কাছ থেকে দেখেছি, এসব এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কীভাবে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। এ থেকেই অনুভব করেছি, এসব এলাকায় সরকারের মনোযোগ কেন আরও বেশি দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারের বরাদ্দ কোথায় কেমন, তা নিয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে পরিচিত হলাম জলবায়ুবিপন্নতা শব্দটির সঙ্গে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন পড়ে জানলাম, জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উন্নয়ন বরাদ্দ যাতে প্রয়োজনমতো যায়, সে জন্য সরকার জলবায়ুবিপন্নতা সূচক (ক্লাইমেট ভালনারেবিলেটি ইনডেক্স) নামের এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এতে কৌশলগত সমর্থন ও কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে গেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনসিডিএফ) এবং ইউএনডিপির লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্প।

এর আগে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ ছিল না। এ প্রকল্প থেকেই এই কার্যক্রমের শুরু। সরকারের প্রজ্ঞাপনেও এ প্রকল্পের উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। এটি প্রশংসা পাওয়ার মতো একটি দারুণ উদ্যোগ। কিন্তু ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম আর ত্রাণ বরাদ্দ নিয়ে কাজ করেন, এমন উদ্যোগী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এ সুরক্ষা উদ্যোগটি সেভাবে প্রচার পায়নি।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন পরিচালিত লজিক প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার, সুইডেন, ডেনমার্ক, ইউএনসিডিএফ ও ইউএনডিপির একটি যৌথ প্রয়াস।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পরপরই জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জন্য খুব ইতিবাচক একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ইউনিয়ন পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা ব্যবহার নির্দেশিকা ২০২১’ সংশোধন করে একটি পত্র জারি করা হয়েছে।

‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় অধিক জলবায়ু-বিপদাপন্ন এলাকাগুলোর অভিযোজনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে আয়তন, জনসংখ্যা ও অনগ্রসরতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার জলবায়ু বিপদাপন্নতাকে অন্যতম সূচক বিবেচনায় নিয়ে’ কিছু পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক জলবায়ু বিপদাপন্নের কথা ভেবে সুনির্দিষ্ট অর্থ শতকরা হারে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

সরকারের এ উদ্যোগ অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। সেটি করা হয়নি। বর্তমান সরকার যে নির্দেশিকা পরিবর্তন করেছে, সেই নির্দেশিকা কেবল স্থানীয় সরকারের বরাদ্দের ক্ষেত্রে নয়, সর্বত্রই চাহিদাভিত্তিক জনগুরুত্ব বিবেচনায় সব বরাদ্দ হওয়া জরুরি।

এ নদীর দুই পারের লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হচ্ছেন। গুরুত্ব বিবেচনার তুলনামূলক নীতিমালা না থাকায় তিস্তায় টাকা বরাদ্দ না করে সরকার অন্যত্র তুলনামূলক কম ক্ষতিকর ঘাঘট নদীতে কাজ করছে। অথচ এ টাকা তিস্তায় ব্যয় করলে অনেক মানুষের উপকার হতো।

সরকারের প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে প্রণীত নির্দেশিকায় ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দের ৭৫ শতাংশের বিভাজন ছিল আয়তন ও জনসংখ্যার নিরিখে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওই ধারায় পরিবর্তন এনে বলা হয়েছে ৭৫ শতাংশ অর্থের ৪০ শতাংশ আয়তন, ৩০ শতাংশ জনসংখ্যা এবং ৩০ শতাংশ হবে ইউনিয়ন পরিষদের জলবায়ু বিপন্নতা সূচকের ওপর ভিত্তি করে। স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলোর একেকটির ক্ষেত্রে এই হার একেক রকম। ইউনিয়ন পরিষদের জন্য সংশোধিত নীতিমালা কতখানি কার্যকর হচ্ছে, সে বিষয়েও দৃষ্টি রাখতে হবে।

বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়নের চাহিদা সর্বত্র সমান নয়। বিশেষ করে জলবায়ুর পরিবর্তন কিংবা অভিঘাতের কারণেও চাহিদার তারতম্য ঘটে। বিভাগ, জেলা তো বটে, ইউনিয়নভিত্তিক চাহিদাতেও আছে ব্যাপক তারতম্য। অনেক ইউনিয়ন আছে, যার অনেকাংশ কিংবা সম্পূর্ণ ইউনিয়ন নদীবেষ্টিত। অনেক ইউনিয়ন আছে, যেগুলো সমুদ্র উপকূলবর্তী।

অনেক স্থানে আছে পাহাড়। রাজশাহী অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট আছে অনেক স্থানে। উপকূলবর্তী অনেক এলাকায় আছে সুপেয় পানির সংকট। পাহাড়ি এলাকার সংকটও ভিন্ন। কোথাও খরা আবার কোথাও বন্যায় বিপর্যস্ত হয় জনপদ।

আমাদের দেশে কোনো কোনো অঞ্চলে প্রতিবছর কয়েকবার বন্যা হয়। আবার কোনো এলাকায় একবারও বন্যা হয় না। উজানের দেশ ভারতের নদীর পানি ছেড়ে দেওয়ার কারণে কিছু নদীতীরের মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। অনেক এলাকা আছে যেখানে প্রচুর নদীভাঙন আছে। প্রতিবছর হাজার হাজার বাড়ি একই স্থানে নদীতে বিলীন হয়। প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ নদীভাঙনে উদ্বাস্তু হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যান। যাঁদের বাড়ি নদীতে বিলীন হয়, তাঁদের জন্য সরকার কোনো কিছুই করে না।

দেশে যেসব শহরের ভেতর দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়েছে, সেগুলোকেও করা হচ্ছে চরম দূষণের শিকার। এককথায় বলা যায়, আমাদের দেশের জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় চাহিদা সমান নয়। বর্তমানে কোথাও বাড়ছে খরা, কোথায় শীত। নদী মেরে ফেলা হচ্ছে ক্রমাগত। ফলে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ।

আমাদের দেশে প্রাকৃতিক কারণে সংকটে পড়া মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকে না। গড়পড়তা যেটুকু থাকে, তা–ও ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি আর ত্রুটিপূর্ণ বরাদ্দপদ্ধতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদে পৌঁছায় না। যদি সমস্যার ধরন আর গুরুত্ব বিবেচনা করে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় করা হতো, তাহলেও অনেকটা উপকার পেতেন দেশের অসহায় মানুষ। সংকট চরমে উঠলে তাৎক্ষণিক যে সামান্য বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা–ও অসম্পূর্ণ।

এখানে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়নগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। কিসের ভিত্তিতে এই ভাগ করা হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়। কোনো জেলায় বন্যা না হলেও কিংবা জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষা পেতে কিংবা অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন না থাকলেও টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। আবার যেসব এলাকা জলবায়ুর কারণে বিপদাপন্ন, সেসব এলাকায় বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় না।

কোভিডকালীন ২০২০ সালে একটি টিভি টক শোতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিসের ভিত্তিতে জেলাগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে? তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। ওই অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর কাছে আরও জানতে চেয়েছিলাম, কোভিডকালীন বিত্তহীন পরিবারের জন্য যে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাতে চরম বৈষম্য কেন? এরও কোনো সদুত্তর ছিল না।

আমাদের দেশে কোনো জেলায় গরিব মানুষের সংখ্যা ৬০ হাজার, কোনো জেলায় ২০ লাখ। জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলাতেও জেলাভিত্তিক সক্ষম মানুষের সংখ্যায় আছে অনেক তারতম্য। ফলে বরাদ্দের ক্ষেত্রে এসব আমলযোগ্য। গরিব মানুষের সংখ্যা বিবেচনা না করেই করোনাকালে যে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এতে দেখা গেছে, মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদীর প্রতিজন গরিব পেয়েছেন প্রায় তিন মণ চাল; আর কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরে পেয়েছেন মাত্র চার থেকে পাঁচ কেজি চাল। কেবল জনসংখ্যা কিংবা আয়তনভিত্তিক জেলাগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করার কারণে এ অবস্থা হয়েছে। দুর্যোগভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকার কারণে সব জেলাকে সরকার একই ভাবে বিবেচনা করে বরাদ্দ দেওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়।

জলবায়ু বিপদাপন্ন অবস্থা দূরীকরণে অনেক মন্ত্রণালয় যুক্ত। যেমন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় যে কাজ করে, তাদের ক্ষেত্রে এরূপ নীতিমালার ব্যবস্থা করতে হবে। রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীতে ভাঙনরোধে কোনো ব্যবস্থা নেই।

ফলে এ নদীর দুই পারের লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হচ্ছেন। গুরুত্ব বিবেচনার তুলনামূলক নীতিমালা না থাকায় তিস্তায় টাকা বরাদ্দ না করে সরকার অন্যত্র তুলনামূলক কম ক্ষতিকর ঘাঘট নদীতে কাজ করছে। অথচ এ টাকা তিস্তায় ব্যয় করলে অনেক মানুষের উপকার হতো।

জলবায়ুবিপন্নতা সূচকে সরকারের যত দপ্তর, অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয় কাজ করে, সব ক্ষেত্রে জলবায়ুবিপদাপন্ন সূচকের কথা আমলে নিয়ে বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নয়তো কোনো অঞ্চলে প্রভাব খাঁটিয়ে প্রচুর কাজ হবে, কোনো এলাকায় হবে না। নীতিমালা ত্রুটিপূর্ণ হলেও বরাদ্দ যথাস্থানে হবে না। কেবল জলবায়ু বিপন্নতা সূচকে নয়, সরকারের সব উন্নয়নকাজেও এমন নীতি প্রয়োগ করা হোক।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

wadudtuhin@gmail.com