পুতিনের কাছে ট্রাম্পের কথিত ‘সুন্দর ভবিষ্যৎ’-এর কোনো মূল্য নেই।
পুতিনের কাছে ট্রাম্পের কথিত ‘সুন্দর ভবিষ্যৎ’-এর কোনো মূল্য নেই।

মতামত

পুতিনের সঙ্গে বসে ট্রাম্প যে ভুল করলেন

প্রাচীনকালে মানুষ ‘আলটিমা থুলে’ নামের একটি কল্পিত জায়গার কথা বলত। কল্পলোকের সেই জায়গা ছিল পৃথিবীর একেবারে উত্তর প্রান্তে। পৃথিবীর একেবারে শেষ সীমায়।

আলাস্কায় গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেখা করলেন, তখন মনে হচ্ছিল, ট্রাম্প তাঁর নিজের পররাষ্ট্রনীতির আর্কটিক স্বপ্নরাজ্যের সীমান্তে থাকা কল্পলোকের ‘আলটিমা থুলে’-তে পৌঁছে গেছেন।

ট্রাম্প ভেবেছিলেন, অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি আর অহমিকাভরা হুমকি দিয়ে তিনি আমেরিকানদের যেভাবে বশ মানাতে পারেন, বিদেশি সব নেতাকেও একইভাবে সামলাতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব কল্পকাহিনি আমেরিকার বাইরে কাজ করে না।

আদতে ‘সুন্দর ভবিষ্যতের’ ফাঁপা কথা শুনে কোনো স্বৈরশাসক থেমে যায় না। কারণ, সে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে অপরাধ করেই এগোতে চায়। আর যারা যুদ্ধ ও হামলার শিকার, যারা নিজেদের জমি–সম্পদ রক্ষা করছে ও পরিবারকে আগ্রাসন থেকে বাঁচাচ্ছে, যাদের শিশুদের অপহরণ করা হচ্ছে, যে সাধারণ মানুষকে মারা ও নির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের কাছে এসব মিষ্টি কথা কোনো কাজে আসে না।

পুতিনের কাছে ট্রাম্পের কথিত ‘সুন্দর ভবিষ্যৎ’-এর কোনো মূল্য নেই। তাঁর নিজের লক্ষ্য স্পষ্ট—ইউক্রেনে এক পুতুল সরকার বসানো, ভয়ভীতি দিয়ে মানুষকে চুপ করানো, দেশপ্রেমিকদের গণকবর দেওয়া, আর ইউক্রেনের সম্পদ রাশিয়ার কবজায় নেওয়া।

ট্রাম্প মনে করেন, তাঁর হুমকি বিদেশেও কাজ করে, কিন্তু আসলে তা হয় না। এটা ঠিক, অনেক আমেরিকান তাঁকে ভয় পায়। তিনি নিজের দলে যাদের পছন্দ নয়, তাদের সরিয়ে দিয়েছেন, আর ভয় দেখিয়ে রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। এমনকি তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীকে পুলিশের মতো ব্যবহার করেছেন। এ কাজ তিনি প্রথমে করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ায়, তারপর ওয়াশিংটন ডিসিতে।

বিদেশি শত্রুরা ট্রাম্পের এসব কাজকে আমেরিকানদের মতো ভয় বা আতঙ্কের চোখে দেখে না। যেসব ব্যাপার আমেরিকানদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়, সেগুলো দেখে বরং আমেরিকার শত্রুরা মজা পায়। যেমন মস্কো (রাশিয়ার দিক থেকে) মনে করে, আমেরিকার ভেতরে সেনা নামানো আসলে শক্তি নয়, বরং দুর্বলতার চিহ্ন।

আমেরিকায় ট্রাম্পের বড় বড় কথা অনেকের কাছে দারুণ শোনালেও বাস্তবে তা শুধু ফাঁপা কথা, কাজ নয়। আমেরিকানরা অনেক সময় কথা আর কাজকে এক মনে করে। কিন্তু রাশিয়ার নেতারা এসবকে আসল শক্তি ভাবেন না; বরং এসব কথাকে তাঁরা আমেরিকার দুর্বল বৈদেশিক নীতি লুকানোর চেষ্টা মনে করেন।

ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, পুতিন যদি নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি না মানেন, তবে ‘ভয়াবহ পরিণতি’ হবে। কিন্তু এগুলো কেবল কথার কথা। এখন আলাস্কায় এসে পরিষ্কার হয়েছে—এটিই তাঁর ‘আলটিমা থুলে’, এটিই তাঁর কল্পনার জগতের সীমান্ত। এখান থেকে ট্রাম্প কোথায় যাবেন?

ট্রাম্প রাশিয়াকে বড় বড় ছাড় দিয়েছেন, অথচ বিনিময়ে কিছুই পাননি। বরং রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে আর তাদের সরকারি টিভিতে ট্রাম্পকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে।

ট্রাম্প আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেই রাশিয়ার জন্য বড় ছাড় দিলেন। এর মাধ্যমে তিনি ক্রেমলিনের ওপর পশ্চিমাদের তিন বছরের বেশি সময়ের কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন। ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ট্রাম্প আসলে এই বার্তাই দিলেন, ইউক্রেনে হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন আর শিশু অপহরণের মতো অপরাধগুলো তাঁর কাছে কোনো ব্যাপার নয়।

আলাস্কাকে বৈঠকের জায়গা হিসেবে ঠিক করাটাও ছিল রাশিয়ার জন্য একধরনের ছাড়, আর সেটা বেশ অদ্ভুতও। কারণ, রাশিয়ানরা, বিশেষ করে তাদের সরকারি মিডিয়ার বড় বড় লোকজন প্রায়ই আলাস্কাকে রাশিয়ার ভূখণ্ড বলে দাবি করে থাকেন। এরপরও ট্রাম্প আলাস্কায় অবস্থিত আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে এ ধরনের লোকদের আমন্ত্রণ করলেন।

সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যুদ্ধের শুরুটা করেছে যে রাশিয়া, ট্রাম্প সেই রাশিয়াকে ডাকলেন, কিন্তু যাদের দেশ আক্রান্ত হয়েছে, সেই ইউক্রেনের কাউকে একেবারেই ডাকলেন না। এ ঘটনাকে ট্রাম্পের পুরোপুরি ‘আলটিমা থুলে’ বা কল্পনার জগতে চলে যাওয়া বলা যেতে পারে।

এর চেয়েও গুরুতর ছাড় ট্রাম্প আগেই দিয়ে ফেলেছেন। তিনি কখনোই রুশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বলেন না; রাশিয়ার যে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত, তা নিয়েও তিনি কথা বলেন না।

উল্টো ট্রাম্প স্বীকার করেন, ন্যাটো সদস্যপদ প্রশ্নে ইউক্রেন আর আমেরিকার বৈদেশিক নীতি রাশিয়া ঠিক করবে। এমনকি তিনি মানতে রাজি যে রাশিয়ার আক্রমণ শুধু মাঠের বাস্তবতায় নয়, আইনিভাবেও এই যুদ্ধ সীমান্ত পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

যদি রাশিয়ার আক্রমণকে বৈধভাবে সীমান্তবদলের উপায় হিসেবে ধরা হয়, তাহলে গোটা বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে যাবে। আবার যদি রাশিয়াকে অন্য দেশের বৈদেশিক নীতি ঠিক করার অধিকার দেওয়া হয়, তবে সেটা রাশিয়ার মতো দেশকে আরও আগ্রাসী হতে উৎসাহিত করবে। আর যুদ্ধাপরাধের জন্য যে স্বাভাবিক শাস্তি বা প্রতিকার হওয়া উচিত (যেমন ক্ষতিপূরণ দেওয়া বা অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা), তা যদি না করা হয়, তাহলে সারা বিশ্বে যেন যুদ্ধ করা বৈধ হয়ে যাবে।

ট্রাম্প বড় বড় কথা বলেন, কিন্তু আসলে তাঁর হাতে তেমন ক্ষমতা নেই। তিনি মনে করেন, শুধু কথায় সমস্যার সমাধান হবে। এ কারণে তিনি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন, যেখানে পুতিন যা বলেন, সেটাই শেষ কথা হয়ে যায়। তাই ট্রাম্পকে আলাস্কা পর্যন্ত গিয়ে শুধু ‘শোনার ভান’ করতে হয়েছে। ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবনে বারবার দেখা গেছে, তিনি পুতিনের কথা শোনেন, তারপর আবার সে কথাই বলেন।

ট্রাম্প আর পুতিন দুজনই ভবিষ্যতে খুব বড় নেতা হিসেবে স্মরণীয় থাকতে চান। পুতিন বিশ্বাস করেন, যুদ্ধের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব, আর মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করাও তাঁর পরিকল্পনার অংশ। অন্যদিকে ট্রাম্প ভাবেন, যদি তাঁর নাম শান্তির সঙ্গে জড়িয়ে যায়, তবে তাঁর উত্তরাধিকার গড়ে উঠবে। কিন্তু নীতি বানাতে তিনি নিজে সক্রিয় নন; তাই শেষ পর্যন্ত তিনি পুতিনের নিয়ন্ত্রণে চলে যান।

আর যখন ট্রাম্প রাশিয়ার কথা হুবহু বলে দেন, তখন পুতিন যুদ্ধ থামাতে আরও নিরুৎসাহিত হন। তাঁকে তখন কোনো অস্পষ্ট ‘সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন’ দিয়েও ফাঁদে ফেলা যায় না। কারণ, তাঁর লক্ষ্য স্পষ্ট—ইউক্রেনকে ধ্বংস করা।

আলাস্কায় এসে ট্রাম্প তাঁর ব্যক্তিগত ‘আলটিমা থুলে’তে পৌঁছালেন। তিনি তাঁর কল্পনার দুনিয়ার শেষ সীমায় চলে গেলেন। সেখানে তাঁর সামনে ছিল খুব সহজ একটি প্রশ্ন—পুতিন কি ট্রাম্পের দাবিমতো নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি মেনে নেবেন?

পুতিন আলাস্কাতেও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি যুদ্ধবিরতি মানবেন না। এর পাশাপাশি রাশিয়া ট্রাম্পের দাবির উল্টো একটি অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি হলো ইউক্রেনকে এমন কিছু জমি আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার কাছে দিতে হবে, যা রাশিয়ার দখলে নেই; বরং ইউক্রেন সেখানে নিজেদের প্রতিরক্ষা তৈরি করেছে। রাশিয়ার এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া হলে রাশিয়া আবার আরও ভালো অবস্থান থেকে আক্রমণ চালাতে পারবে।

পুতিন জানেন, ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কার চান। তাই তাঁর চাল হলো—ট্রাম্পকে বলা, যুদ্ধ একদিন শেষ হবে, আর তখন কৃতিত্ব পাবেন ট্রাম্প। শর্ত একটাই, তাঁরা যেন আলাপ চালিয়ে যান। আলাস্কা ছাড়ার আগে পুতিন বলেও ফেললেন, ‘পরেরবার মস্কোয়?’ পুতিন ঠিক করেছেন, তিনি একদিকে আলোচনা চালাবেন, অন্যদিকে ইউক্রেনে বোমা ফেলতেই থাকবেন।

এখন যেহেতু ট্রাম্প রাশিয়ার কাছ থেকে কোনো নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি আনতে পারেননি, তাঁর সামনে দুটি পথ আছে। এক. তিনি কল্পনার দুনিয়ায় পড়ে থাকবেন। দুই. তিনি যুদ্ধকে পুতিনের জন্য কঠিন করবেন, আর এর মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি এগিয়ে আনবেন।

যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত রাশিয়ার প্রতি এসব অদ্ভুত ছাড়কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। ট্রাম্প চাইলে এখনই এক সংবাদ সম্মেলনে সব তুলে নিতে পারেন। আমেরিকার হাতে যুদ্ধের গতিপথ পাল্টানোর জন্য যথেষ্ট নীতি-অস্ত্র আছে; প্রয়োজনে তা ব্যবহারও করা যেতে পারে। কিন্তু ট্রাম্প তা করবেন বলে মনে হয় না।

ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, পুতিন যদি নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি না মানেন, তবে ‘ভয়াবহ পরিণতি’ হবে। কিন্তু এগুলো কেবল কথার কথা। এখন আলাস্কায় এসে পরিষ্কার হয়েছে—এটিই তাঁর ‘আলটিমা থুলে’, এটিই তাঁর কল্পনার জগতের সীমান্ত। এখান থেকে ট্রাম্প কোথায় যাবেন?

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

টিমোথি স্নাইডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঙ্ক স্কুল অব গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড পাবলিক পলিসির মডার্ন ইউরোপিয়ান হিস্ট্রির চেয়ার।