বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি থেকে বিভিন্ন বই পুড়িয়ে দেন একদল রাজনৈতিক শিক্ষার্থী
বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি থেকে বিভিন্ন বই পুড়িয়ে দেন একদল  রাজনৈতিক শিক্ষার্থী

মতামত

বই পোড়ানোর রাজনীতিটা আসলে কী

গত শতকের ষাটের দশক দুনিয়াজুড়েই ‘মুক্তির দশক’ বলে পরিচিত পেয়েছিল। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকাজুড়ে কোথাও জাতীয়তাবাদী, কোথাও উপনিবেশবাদবিরোধী, আবার কোথাও পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন এবং তরুণ বিদ্রোহ শাসকগোষ্ঠীর ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল।

আমাদের ঘরের পাশেই পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে নকশালবাড়িতে কৃষকদের সংগঠিত করে জোতদারদের বিরুদ্ধে চারু মজুমদার, কানু স্যানালরা যে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেই ঢেউ শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, উপমহাদেশজুড়েই প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছিল। ‘চলো, চলো গ্রামে চলো’ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে ছাত্র-তরুণেরা ‘শ্রেণিচ্যুত’ হতে নিজেদের পড়াশোনা ও চাকরি-ব্যবসা ছুড়ে ফেলে কৃষক ও শ্রমজীবীদের অঞ্চলে থাকতে শুরু করেছিলেন।

শত শত তরুণের আত্মত্যাগের পরও সেই প্রচণ্ড আলোড়ন তোলা আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। এর একটা বড় কারণ ছিল ভারতের শাসকেরা নিষ্ঠুর বল প্রয়োগ করে নকশালবাড়ির বিপ্লবীদের দমন করেছিল। কিন্তু এই আন্দোলনে পুরোনো রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক কাঠামো ভাঙার নাম করে বই পোড়ানো, গ্রন্থাগার ভাঙা, মূর্তি ভাঙার কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। নকশালপন্থী ছাত্ররা ‘প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য’ ও ‘বুর্জোয়া শিক্ষা’কে প্রত্যাখ্যান করার নামে গ্রন্থাগার আক্রমণ করেছিল এবং বই পুড়িয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্রের মতো লেখকদের বইকে ‘বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রতীক’ আখ্যা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

খুব স্বাভাবিকভাবেই হঠকারী এই সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তীব্র। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বড় একটা অংশের জনমত নকশালদের বিপক্ষে চলে যায়। বই পুড়িয়ে কিংবা মূর্তি ভেঙে যেকোনো প্রতীক বা চিহ্ন যে নিশ্চিহ্ন করা যায় না, বরং তার উল্টো ফল হয়, নকশাল বিপ্লবীদের আন্দোলন তার কাছের অতীতের দৃষ্টান্ত।

‘বইয়ের মান যা–ই থাকুক, বিষয় যা–ই হোক, মতের মিল থাকুক বা না থাকুক, শত্রু লিখুক বা মিত্র লিখুক, বই নিয়ে কর্মসূচি একটাই হতে পারে, সেটা হলো বই পড়া!’

ধান ভানতে এতটা শিবের গীত গাওয়ার কারণ হচ্ছে, গত এক সপ্তাহে ঢাকা ও বরগুনায় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে ১৩ আগস্ট। বিডিনিউজের খবর জানাচ্ছে, ঢাকার মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গ্রন্থাগারে ঢুকে বই কলেজটির মাঠে নিয়ে আসা হয়।

এরপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান তুহিন। শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা বইসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তুহিনের ভাষ্য হলো, ‘আমাদের সংগঠনের কেউ নয়—এমন একজন আমাদের ওপর দায় চাপাতে বইয়ে আগুন দেন।’ তাঁর এই ভাষ্য কতটা গ্রহণযোগ্য?

এরপরের ঘটনাটি বরগুনা সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বরগুনা সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগারে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত’ বিভিন্ন ধরনের চার শতাধিক বই বের করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সময় কলেজ শাখা ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের (সাবেক) নেতা-কর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর যে আইনশৃঙ্খলার শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেই সুযোগে কোনো কোনো গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে পাঠাগারে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছিল। এর মধ্যে কুমিল্লার বীরচন্দ্র পাঠাগার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শত বছরের প্রাচীন পাঠাগারটিতে দুই শ বছরের পুরোনো বইয়ের সংগ্রহও ছিল। ফলে ঐতিহাসিক বিচারে অনেক অমূল্য সম্পদ হারাতে হয়েছে।

পাঠাগার পোড়ানো, মাজার ও ভাস্কর্য ভাঙার মতো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলোর মতাদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা করে নিতে পারি। কিন্তু অভ্যুত্থানের এক বছর পর এসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা যখন বই পোড়ানোর মতো প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়, তখন প্রশ্নটি আসা স্বাভাবিক যে তারা কোন মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

আমাদের রাজনীতি যে আধুনিক ও গণতন্ত্রমনস্ক হয়ে ওঠেনি, বরং গোত্রমনস্ক রয়ে গেছে, তার একটা বড় দৃষ্টান্ত হলো ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের মতো করে ইতিহাস বানানোর প্রকল্প নেন। এই প্রকল্পে দেবত্ব আরোপ করা যায়, এমন কাউকে আইকন হিসেবে দাঁড় করানো হয়। ইতিহাসের নির্মিতি চলে তাঁকে ঘিরেই। এর বিপরীতে ইতিহাসের আর সব ধারাকে জোর করে মুছে ফেলার চেষ্টা চলে। ক্ষমতাসীনদের হয়ে ইতিহাস বানানো আর ইতিহাস মোছার শত শত ভাড়াটে লেখক-বুদ্ধিজীবী তৈরি হয়ে যায়। ক্ষমতার আইকনের পক্ষে স্তুতি, বন্দনাভরা বই লেখেন তাঁরা। এসব বইয়ের বড় একটা অংশ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারিভাবে কেনা হয়।

এর সবটাই সত্য। আবার শেখ মুজিব কিংবা মুক্তিযুদ্ধের নামে আওয়ামী লীগের আমলে দমন–পীড়ন করা হয়েছে, সেটাও সত্যি। কিন্তু তাই বলে বই পোড়ানোর মতো প্রতিক্রিয়াশীল কর্মসূচি কেন? যাঁরা নিপীড়ন করেছেন, যাঁরা দুর্নীতি করেছেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাঁদের শাস্তি হোক।

চাপিয়ে দিয়ে যেমন ইতিহাস বানানো যায় না, আবার মুছে দেওয়ার চেষ্টা করলেই যে ইতিহাসের বাস্তবতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায় না, আওয়ামী লীগের শাসনকাল তার খুব কাছের দৃষ্টান্ত। ফলে কারা বই পোড়াচ্ছে, কেন বই পোড়াচ্ছে—সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। এই আত্মঘাতী কাজ যারা করেছে, তাদের রাজনীতিটা আসলে কী?

শেষটা করা যাক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের একটা মন্তব্য দিয়ে। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বইয়ের মান যা–ই থাকুক, বিষয় যা–ই হোক, মতের মিল থাকুক বা না থাকুক, শত্রু লিখুক বা মিত্র লিখুক, বই নিয়ে কর্মসূচি একটাই হতে পারে, সেটা হলো বই পড়া!’

কাজেই বই লেখা আর বই পড়াই একমাত্র জবাব হতে পারে। 

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী