এইচএসসি পরীক্ষা
এইচএসসি পরীক্ষা

মতামত

এইচএসসি পরীক্ষা: ‘ওভারমার্কিং’ না করার সিদ্ধান্ত কি যথার্থ হয়েছে

২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফল সবাইকে রীতিমতো হতবাক করেছে। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম। এ বছর প্রায় সাড়ে ১০ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৬ লাখের কম শিক্ষার্থী পাস করতে পেরেছেন। তার মানে ১০ জন শিক্ষার্থীর অন্তত ৪ জন পাসই করতে পারেননি। গত দুই দশকের মধ্যে এমন ভয়াবহ ফল আর হয়নি। তখন পাসের হার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে থেকেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় এই ফল বিপর্যয়ের কারণ কী। আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফল প্রকাশের দিন সংবাদ সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে কোনো ছক বেঁধে দিইনি বা নির্দিষ্ট করে দিইনি যে এভাবে নম্বর ছাড় দেবেন অথবা ওভারমার্কিং করবেন। বেশি বেশি দিয়ে পাসের হার বাড়াতে হবে, এ রকম কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’ অর্থাৎ নম্বর বাড়ানোর জন্য বা পাসের হার বেশি দেখানোর জন্য বোর্ড বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে কোনো রকম নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের ব্যাপার অতীতে ঘটেছে। আর তার ফলে পাসের হার যথেষ্ট বেশি দেখানো সম্ভব হয়েছে। সেটি ভালো হয়নি, এটা সবাই মানবেন; কিন্তু হঠাৎ এ বছর এর বিলোপ ঘটানোর ফলে নতুন সংকট যে তৈরি হতে পারে, এটা হয়তো কেউ ভেবে দেখেননি। এ বছর এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে চাকরির বাজারে লড়াইয়ে নামবেন; কিন্তু ‘ওভারমার্কিং’–এর সুবিধা না পাওয়ার কারণে তাঁরা তাঁদের আগের কয়েক বছরের শিক্ষার্থীদের চেয়ে শুরুতেই পিছিয়ে থাকবেন। অথচ এ জন্য তাঁদের কোনো দায় ছিল না।

তা ছাড়া আশানুরূপ ফল না পাওয়ার কারণে অসংখ্য পরীক্ষার্থীর মধ্যে হতাশা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এর আগে রেজাল্টের কারণে আত্মহত্যা করার প্রবণতাও দেখা গেছে। এ বছরের ‘যথার্থ’ মূল্যায়নপদ্ধতির দরুন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী আগের বছরের চেয়ে শতকরা ৫২ ভাগ কমে হয়েছে ৬৩ হাজার ২১৯ জন। অথচ ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন। আবার আগের বছর একজনও পাস করতে না পারা কলেজের সংখ্যা ছিল ৬৫। এবার এ রকম কলেজের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০২। 

কোনো সিদ্ধান্ত একটি বছরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে নেওয়া অযৌক্তিক ও অমানবিক। একই সঙ্গে খাতা মূল্যায়ন ও নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা বোর্ডের কোনো নির্দেশনা না থাকার ব্যাপারটিও যৌক্তিক নয়। লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রশ্ন অনুযায়ী নম্বর দেওয়ার মানদণ্ড নির্ধারণ করা দরকার। অর্থাৎ কোন ধরনের ভুলের জন্য কত নম্বর কাটা হবে কিংবা কোন ধরনের উপস্থাপনার জন্য কত নম্বর যুক্ত হবে, সেটি আগেই ঠিক করা দরকার। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের বসিয়ে আগেই এটি নির্ধারণ করতে হবে। পরীক্ষার খাতা পরীক্ষকদের কাছে বণ্টনের সময়ে এই নির্দেশিকাও তাঁদের হাতে তুলে দিতে হবে। 

এমনিতেই এ ধরনের পাবলিক পরীক্ষায় মেধা যাচাই করা কঠিন। কারণ, নম্বরের ব্যাপারটি আপেক্ষিক এবং শিক্ষকভেদে তার হেরফের হয়; কিন্তু উত্তরের ধরন অনুযায়ী মানদণ্ড নির্ধারণ করা সম্ভব হলে পরীক্ষকদের মধ্যে নম্বর দেওয়ার প্রবণতার পার্থক্য কমিয়ে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে খেয়াল রাখা দরকার, খাতা মূল্যায়নের পদ্ধতিতে হঠাৎ আমূল পরিবর্তন আনা ঠিক নয়। এটি করা হলে কোনো বছরের শিক্ষার্থীরা প্রতারিত হতে পারেন; কিংবা বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন। 

এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফল মূল্যায়ন করে শিক্ষা উপদেষ্টা নিজেও স্বীকার করেছেন, প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি তৈরি হয় এবং সেই ঘাটতি বছরের পর বছর ধরে বাড়তে থাকে। তিনি আরও বলেন, আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি, যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছে। এখানে পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক, জিপিএ-৫–এর সংখ্যা তৃপ্তির মানদণ্ড!

আমরাও বহুদিন ধরে বলে এসেছি, পাসের হার আর জিপিএ-৫-এর সংখ্যা দেখে শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে না। শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার। এই কমিশনের কাজ হবে শিক্ষার সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করা। তিন-চার দশক আগে বাংলাদেশে শিক্ষাবিস্তারের প্রধান সমস্যা ছিল অধিক জনসংখ্যা এবং দারিদ্র্য। এখন এর সঙ্গে নতুন নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে। 

এখন শিক্ষা হয়ে পড়েছে পুরোপুরি প্রাইভেট ও কোচিংনির্ভর। শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা অভিযোগ করে থাকেন, শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। এর বাইরেও দৃশ্যমান অনেক সমস্যা আছে। যেমন বিজ্ঞান শাখার জন্য কলেজগুলোতে পরীক্ষাগারের অভাব রয়েছে। যেসব কলেজে পরীক্ষাগার আছে, সেখানেও প্রায় ক্ষেত্রে ঠিকমতো ল্যাব ক্লাস হয় না। এ ছাড়া পদার্থ, রসায়ন, উচ্চতর গণিত ইত্যাদি বিশেষায়িত বিষয়ের জন্য ভালো শিক্ষক নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীরা তাই না বুঝেই বিজ্ঞানের মতো বিষয় মুখস্থ করছে।

বর্তমানে শিক্ষার্থীদের অবস্থা যে কত ভয়াবহ, সেটি বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়েও। উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসের ওপর প্রশ্ন করা হলেও ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে শতকরা মাত্র ১০-১২ ভাগ শিক্ষার্থী। বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা—সব শাখাতেই একই অবস্থা।   


তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক