
গত অক্টোবরে আরও কিছু কমিশনের পাশাপাশি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কার কমিশনের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। প্রশাসনিক সংস্কারের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে লিখেছেন সৈয়দা লাসনা কবীর ও মোহাম্মাদ ঈসা ইবনে বেলাল
এ অঞ্চলে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের ইতিহাস দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময়। এর যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই, যখন একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের লক্ষ্যে তারা কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। উল্লেখযোগ্য কমিশনগুলো হলো—হিচিসন কমিশন (১৮৮৬), ইসলিংটন কমিশন (১৯১২), লি কমিশন (১৯২৪) ও সাইমন কমিশন (১৯৩০)।
এসব কমিশনের মূল লক্ষ্য ছিল এ অঞ্চলের মানুষের প্রশাসনে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ তৈরি করা এবং এমন একটি আমলাতন্ত্র গঠন করা, যা ব্রিটিশ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারবে। পাকিস্তান আমলে কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও গণতন্ত্রের অভাব ও সামরিক শাসনের কারণে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান প্রশাসনিক পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে ‘সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটি’ গঠন করেন। এরপর ১৯৭২ সালে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রি–অর্গানাইজেশন কমিটি’ এবং ‘ন্যাশনাল পে–স্কেল কমিশন’ গঠন করা হয়। এসব কমিশনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠা এবং একটি নতুন বেতনকাঠামো তৈরি করা হয়।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ‘পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন’ গঠন করা হয়, যার লক্ষ্য ছিল প্রশাসনের পুনর্গঠন ও বেতনকাঠামো উন্নয়ন। তার পরবর্তী সময়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন। এগুলোর মধ্যে ‘মার্শাল ল কমিটি’, প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি (সিএআরআর), জাতীয় বেতন কমিশন ইত্যাদি। এসব কমিশনের উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বলতে থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা এবং নতুন বেতনকাঠামো প্রবর্তন করা হয়।
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য একটি সংস্কার কমিটি গঠন করে; যদিও এই কমিটি কোনো সুপারিশ জমা দিতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময় ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসন সংস্কার কমিশন (এসিআর) এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন (পিএআরসি) গঠন করে, যার লক্ষ্য ছিল স্বচ্ছ, জবাবদিহি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
২০০৫ সালে বিএনপি সরকার ‘ট্যাক্স অমবাডসম্যান আইন’ পাস করে, যা আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ছিল। সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে ‘রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন’ গঠন করে এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার মতো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এসে প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য কর্মদক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি (পিবিইএস) প্রবর্তনের চেষ্টা করে, যা জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রশাসনিক কার্যকারিতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল। তবে এসব কমিশনের বেশির ভাগ প্রস্তাবনাই সরকার বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের ব্যর্থতার পেছনে কিছু সাধারণ কারণ দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান।
প্রথমত, রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রশাসনিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ফলে অধিকাংশ সংস্কার উদ্যোগ কেবল পরিকল্পনা পর্যায়ে থেকে যায় এবং বাস্তবে তার সুফল জনগণ ভোগ করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, উপনিবেশবাদী আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর প্রভাব এখনো বাংলাদেশে বিদ্যমান। ব্রিটিশ শাসনকালে গড়ে ওঠা আমলাতন্ত্র কেন্দ্রভিত্তিক এবং স্বচ্ছতার অভাবে ভুগছে। সরকারি কর্মকর্তারা পরিবর্তনকে তাঁদের ক্ষমতা এবং প্রভাবের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে থাকেন। তাঁরা প্রশাসনিক সংস্কারকে তাঁদের পদমর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধার জন্য ক্ষতিকর মনে করেন। এ কারণে প্রায়ই তাঁরা সংস্কারের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়ান; এমনকি তাঁরা সংস্কারের কাজে ধীরগতির নীতি গ্রহণ করেন, যাতে তা বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি হয়।
তৃতীয়ত, ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যখন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁরা প্রায়ই প্রশাসনিক সংস্কারের বিরোধিতা করেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য থাকে নিজেদের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক সুবিধা রক্ষা করা, যা প্রশাসনের উন্নয়ন ও জনসাধারণের কল্যাণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে প্রশাসনিক সংস্কার সফলভাবে বাস্তবায়িত হয় না।
চতুর্থত, প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট (পোষক-পোষ্য) সম্পর্কের কারণে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের অনুগত কর্মকর্তারা পদোন্নতি পান, অন্যদিকে বিরোধী মতাবলম্বী কর্মকর্তারা প্রশাসনিকভাবে অকার্যকর বা ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে চিহ্নিত হন। এই ধরনের পক্ষপাতিত্ব প্রশাসনের দক্ষতা এবং কার্যকারিতাকে দুর্বল করে তোলে। সরকার তাদের পছন্দের আমলাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে প্রশাসনিক সংস্কারের বিরোধিতা করে, এ কারণে সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবও প্রশাসনিক সংস্কারের পথে একটি বড় বাধা। অনেক সময় প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগ এবং সংস্থা সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, দক্ষতা বা প্রযুক্তিগত জ্ঞান রাখে না। একই সঙ্গে, আইনের শাসনের দুর্বলতা এবং প্রশাসনের স্বায়ত্তশাসনের অভাবও সংস্কারের সঠিক বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে।
এ ছাড়া নাগরিকদের অংশগ্রহণের অভাব বাংলাদেশে প্রশাসনিক সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। সংস্কারের সফল বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ করা এবং তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু প্রায়ই সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের মতামত বা সুপারিশ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন। এমনকি যখন অংশীদারদের পরামর্শ নেওয়া হয়, তখনো তাঁদের মতামত বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। এই পরামর্শের অভাব এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণের অভাব প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতাকে দুর্বল করে এবং প্রশাসনিক সংস্কারের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ। এই সরকার মূলত রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং রাজনৈতিক দলের সরাসরি সহায়তা ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটি একটি অনন্য পরিস্থিতি, যা দেশের উন্নয়ন ও সংস্কারের ধারায় নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করছে। যেহেতু এ সরকারের দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ নেই, তাই জনগণ আশা করছে যে এই সরকার দেশের সংস্কারে সফল হবে। তবে একটি বিষয় বেশ উদ্বেগজনক; এই সরকার কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, তা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। এ কারণে সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ প্রয়োজন, যা দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব; পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত, যাতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।
জনপ্রশাসনকে জনমুখী করার জন্য প্রশাসনিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ শাসন দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে এ দেশে আধুনিক আমলাতন্ত্রের সূচনা করেছিল। সেই সময়ে জনগণের সেবা মুখ্য ছিল না; বরং ব্রিটিশ শাসনের সুবিধার্থে একটি কেন্দ্রীভূত ও নিয়ন্ত্রণমূলক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা হয়। এ কারণে ওই আমলাতন্ত্র কখনোই জনগণের সেবায় উৎসর্গিত হতে পারেনি।
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, আমলাতন্ত্র প্রায়ই সামরিক শাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এরপর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৯১ সাল থেকে প্রশাসনে দলীয়করণের প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করে। ২০০৮ পরবর্তী সময়ে আমলাতন্ত্র তার নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলে এবং দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সমর্থক সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করে, যার ফলে প্রশাসন জনগণের থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটে, বর্তমান সংস্কার কমিটির অন্যতম লক্ষ্য—প্রশাসনকে জনমুখী করা। এটা অত্যন্ত কঠিন চ্যালেঞ্জ। অতীতে প্রশাসন জনগণের প্রত্যাশা পূরণে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারের আদেশ বাস্তবায়ন; জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করা নয়।
প্রশাসনিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতার ওপর জোর দিতে হবে। তাঁদের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে দেশের প্রকৃত মালিক জনগণ ও প্রশাসনের মূল লক্ষ্য জনগণের সেবা করা। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার নীতিমালা যদি কর্মকর্তাদের মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে প্রশাসন সত্যিকারের জনমুখী হয়ে উঠবে এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করবে।
প্রশাসনে স্বচ্ছ জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রশাসনের জনমুখীকরণও সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বর্তমানে শুধু উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধীনস্থ কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) মূল্যায়ন করে থাকেন। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে প্রশাসনের কোনো সরাসরি জবাবদিহি নেই। এ কারণে সেবা গ্রহণের সময় জনগণ প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির শিকার হন।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রশাসনের কার্যক্রমে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। প্রতিটি সরকারি দপ্তরে একটি অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা যেতে পারে বা অনলাইনে অভিযোগ দাখিলের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে জনগণ তাঁদের অসন্তোষ ও অভিযোগ সরাসরি প্রশাসনের নজরে আনতে পারবেন। এতে কর্মকর্তারা তাঁদের কাজে আরও মনোযোগী ও দায়িত্বশীল হবেন। পাশাপাশি সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন এসব অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অসৎ কর্মকর্তাদের দ্রুত শনাক্ত করতে পারবে, যা প্রশাসনে দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে ক্যাডারভিত্তিক দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। অন্যান্য দেশের মতো এখানে সাধারণ কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরাজমান এই দ্বন্দ্ব প্রশাসনের সামগ্রিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ঐতিহ্যগতভাবে সাধারণ কর্মকর্তারা সুবিধাজনক পদে বসে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, যেখানে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকে মূলত প্রযুক্তিগত বিষয়ে।
বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষের অন্যতম প্রধান কারণ হলো, সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো সাধারণ কর্মকর্তারা দখলে রাখেন। এমনকি যেসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অপরিহার্য, সেখানেও সাধারণ কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এ পরিস্থিতি বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও অবদানের যথাযথ স্বীকৃতিতে বাধা সৃষ্টি করে।
এই দ্বন্দ্ব নিরসনে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা জরুরি, যেখানে বিশেষজ্ঞ ক্যাডারভুক্তদের নিয়োগ ও পদোন্নতি শুধু তাঁদের মধ্য থেকেই করা হবে। এর মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে এবং প্রশাসনের উন্নয়নে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে।
প্রশাসনিক সংস্কারের লক্ষ্যগুলো সফলভাবে অর্জন করতে হলে সময়ের চাহিদা, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামোর ক্ষমতা ও উদ্দেশ্যকে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা অপরিহার্য। তবে সংস্কারের প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাবক বা ফ্যাক্টরগুলোর ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। শক্তিশালী রাষ্ট্র, বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিজস্ব এজেন্ডা এবং স্বার্থ থাকায় তারা প্রায়ই এসব সংস্কারের দিকনির্দেশনাকে প্রভাবিত করতে চায়।
তাই প্রশাসনিক সংস্কারের কার্যক্রম কেবল আমলাদের ওপর নির্ভর না করে সমাজের সব স্তরের সমন্বিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যারা সংস্কারের অগ্রগতি তদারক করবে এবং এর সফল বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিশেষ করে প্রশাসনিক সংস্কার একটি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম। এই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে ন্যূনতম কিছু সংস্কার কার্যক্রম দিয়ে এই যাত্রা শুরু করা। মনে রাখতে হবে আগের সব প্রশাসনিক কার্যক্রম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল রাজনৈতিক সমর্থনের অভাব ও আমলাতন্ত্রের বাধার কারণে।
সংস্কার প্রস্তাব করা আর তার বাস্তবায়ন এক বিষয় নয়। আমাদের শুরু থেকেই লক্ষ্য হওয়া উচিত, রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন অর্জন করার চেষ্টা করা এবং তার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কিছু সংস্কার প্রস্তাবকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। একটি অতি উচ্চাভিলাষী সংস্কার প্রস্তাবনা আশাবাদ তৈরি করতে পারে, কিন্তু বাস্তবায়নহীন এই প্রস্তাবনা দীর্ঘমেয়াদি হতাশার জন্ম দেবে।
ড. সৈয়দা লাসনা কবীর অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মাদ ঈসা ইবনে বেলাল গবেষক