‘অভ্যুত্থান পাইলাম, সরকার পাইলেম, কিন্তু উপজেলায় উপজেলায় টাউন হল চত্বরগুলা নিথুয়া পাথার হয়া আছে। এই ঘাটের উঁচা মঞ্চোত বসি এহনা (একটু) গপ্পো, একটু পালা করার সুযোগ আর হইল না।’ চিলমারী নদীবন্দরে বসে হাহাকার নিয়ে কথাগুলো শোনাচ্ছিলেন জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া শিল্পী শফিকুল ইসলাম। শোনালেন একটি ভাওয়াইয়া গানও—‘ওরে দাঁড়িয়ে ঘরোত নাড়িয়ে নানা/ উঁচা টঙোত বসি,/ গপ্পো জুড়ি দিছে ওরে,/ ফোকলা মুখোত হাসি।’
গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে নাটক, সিনেমা ও যাত্রাপালায় জোয়ার আসার কথা ছিল। উপজেলায় উপজেলায় নতুন নতুন নাটকের দল, নতুন সিনেমা হল, বইয়ের দোকান কিংবা বটতলা ও নদীপাড়ে সিমেন্টের চেয়ার-বেঞ্চ দিয়ে মঞ্চ গড়ে ওঠার কথা। প্রতিটি অভ্যুত্থান, প্রতিটি বিপ্লবের পর পুরোনো সংস্কৃতির জায়গায় নতুন সংস্কৃতি আসে। বিপ্লব বা অভ্যুত্থানকে স্থায়ী করতে দরকার হয় সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান। কিন্তু তার বদলে দেখা গেল সেই মুজিব বর্ষ পালনের কায়দায় জুলাই বর্ষ পালন।
বলা হয়, বাড়ির বাইরে অধিক সময় কাটানোর সুযোগ একটি আদর্শ শহরের বৈশিষ্ট্য। একটি আদর্শ শহরে বাড়ি ও পাড়ায় থাকে পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক মাঠ, পুকুর ও ক্লাব ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে পাড়ার এজমালি সম্পত্তি। এগুলোকে কেন্দ্রে রেখেই পাড়া বা মহল্লা গড়ে ওঠে। তেমনি শহর বা এলাকাভিত্তিক গণ–এলাকা থাকে রাস্তা ও মাঠ এবং টাউন হল। বিকেল ও বিশেষ উৎসবে এই জায়গাগুলো ঘিরেই খেলাধুলা, হাঁটা, বসা ও সামাজিক কাজকর্ম চলে।
জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলেই টাউন হলগুলোর চত্বরে চত্বরে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মহড়ার ঘর ও হাটে-ঘাটে-গাছতলায় মঞ্চ নির্মাণের জোয়ার চলে আসবে
একটি শহর কতটা সভ্য, সংস্কৃতিমান, আধুনিক ও জনগণের, তা বোঝা যায় তার গণ–এলাকার সংখ্যার ওপর। পাড়ার মতো শহরের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। তবে পাড়ার মাঠটি পাড়ার বাসিন্দাদের উপযোগী, তেমনি শহরেরটিও হতে হয় শহরের জনসংখ্যা ও তার বৈচিত্র্যের ওপর। টাউন হল তেমন একটি গণ–এলাকা। একটি শহরের টাউন হল নামের গণ–এলাকার ওপর নির্ভর করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম কতটুকু সংগঠিত হবে। পৃথিবীর তাবৎ শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে এসব গণ-এলাকাতেই।
রাজনীতিতেও গণলাইন বলে একটা ব্যাপার আছে। মাও সে–তুংয়ের ভাষায়, ‘গণের মধ্য থেকে গ্রহণ করো, আবার গণের মধ্যেই ফিরিয়ে দাও।’ তার মানে হলো নেতৃত্ব প্রথমে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, মতামত ও সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবে। এরপর সেই তথ্য ও অভিজ্ঞতাগুলো বিশ্লেষণ করে নীতি ও কর্মসূচিতে রূপান্তর করবে। তারপর সেই নীতি আবার জনগণের কাছে নিয়ে গিয়ে বাস্তবায়ন করবে, জনগণকে অনুপ্রাণিত করবে। এতে নেতৃত্ব জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না।
এর ফলে সিদ্ধান্ত এবং নীতি জনগণের চাহিদা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গঠিত হয় এবং নেতা ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও ঐক্য গড়ে ওঠে।
এর বিপরীতে আছে ক্ষমতার পথ। হাসিনার আমলে আমরা মুজিব বর্ষ পালিত হতে দেখেছি। দেখেছি পালনের নামে অসংখ্য মানহীন বই আর চলচ্চিত্র। দেখেছি ড্রোন শো। যেখানে জনগণের কোনো স্বার্থ যুক্ত ছিল না। অভ্যুত্থানের সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও সেই পুরোনো পথেই অভ্যুত্থানের বর্ষ পালন করল। যার প্রভাব জাতির জীবন দূরে থাক, ঢাকা নাগরিকদের মধ্যেও পড়েছে বলে মনে হয় না। পড়লে মাজার ভাঙা, বটগাছ কাটা চলত না।
আর গণলাইন থাকলে জনগণ নিজেরা নিজেদের প্রতিষ্ঠান নির্মাণে এগিয়ে আসেন। রাষ্ট্রের নেতারা সমন্বয় করেনমাত্র। সারা বাংলাদেশে ছড়ানো প্রায় সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন জনগণই গড়ে তুলেছে।
সাংস্কৃতিক উদ্যোগে উপজেলাগুলোতে স্থানীয় বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতে পারে সরকার। ইউএনওদের ঢাকায় ডেকে বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টিদের দায়িত্ব দিতে পারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলেই টাউন হলগুলোর চত্বরে চত্বরে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মহড়ার ঘর ও হাটে-ঘাটে-গাছতলায় মঞ্চ নির্মাণের জোয়ার চলে আসবে। তাতে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে বাড়তি টাকা খরচ হবে না। এ ক্ষেত্রে দরকার শুধু সিদ্ধান্তের।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge1@gmail.com