মতামত

ধানের শীষে কি শাপলা কলি ফুটবে

জুলাই আন্দোলন ছিল স্বল্পকালীন; কিন্তু তা ফল এনেছে বিশাল। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেকে দেশের জন্য অপরিহার্য ভাবা শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে ছাত্ররা দেশের ক্ষমতা নিলেন। যেসব তরুণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা খুব তাড়াতাড়িই ক্ষমতার আস্বাদ পেয়েছেন। কেউ পেয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা। কেউ পেয়েছেন প্রভাব খাটানোর অবাধ স্বাধীনতা। এ পরিস্থিতিতে একসময় তাঁরা দল করলেন। দলটির নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

ছাত্রদের এই দলকে শুরু থেকে অনেকেই ‘কিংস পার্টি’ বলে আসছিল। এর যৌক্তিক কারণও আছে। দেশের এখন যাঁরা ‘কিং’, তাঁদের নিয়োগকর্তাও ছিলেন এই ছাত্ররাই। তাঁরা শুধু রাজনৈতিক দলই করেননি, সরকারে তাঁদের প্রতিনিধি রেখে গেছেন; সরকারের অনেক কলকবজা তাঁরাই নাড়ছেন। অনেকে এর নাম দিয়েছেন ‘সরকারের মাঝে সরকার’।

ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ও চাপের রাজনীতি

আমাদের দেশের জনগণ সব সময় যেকোনো আন্দোলনে ছাত্রদের পেছনে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু আন্দোলন সফল হওয়ার পর ছাত্রদের পেছনে ঠেলে দেয়। তাই
রাজনীতিতে পাকাপোক্ত রাজনীতিবিদেরাই সব সময় এগিয়ে থাকেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের পতাকা উড়িয়েছিলেন যে তরুণেরা, তাঁরা স্বাধীনতার পর জাসদ গঠন করেছেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্রুতই তাঁরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন।

দল গঠনের পর গণসংযোগে গিয়ে যে প্রতিকূল অবস্থায় পড়েন, সম্ভবত সে অভিজ্ঞতাই এনসিপির তরুণ নেতাদের আরও জেদি করে তোলে। এনসিপি নেতাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলোয় এর স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। দল করার প্রথম থেকেই এনসিপি চাপের রাজনীতি শুরু করে। সরকারকে তাদের অনেক দাবি চাপের মুখে মেনে নিতে হয়েছে। সর্বশেষ এনসিপির শাপলা প্রতীক দাবির চাপে নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে শাপলার কলি ফোটাতে হলো।

 প্রথম থেকেই এনসিপির দুটি লক্ষ্য ছিল—ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ও চাপের রাজনীতি অব্যাহত রাখা। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কোনো লুকোচুরি করেনি। তারা স্পষ্টই বলে আসছিল, জুলাই আন্দোলনের স্বার্থ পাহারা দেওয়ার জন্য তাদের সরকারে থাকা উচিত। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টা গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি। বিভিন্ন সময় তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়েও তাঁরা প্রকাশ্যে চাপ সৃষ্টি করেছেন। এভাবে এনসিপি জন্ম থেকেই দারুণ প্রভাব ও সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

এনসিপি পথ খুঁজছে

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। বর্তমানে যারা ক্ষমতায়, তারা চলে যাবে; নতুন সরকার আসবে। সরকারের ছায়া ছাড়াই এনসিপিকে রাজনীতি করতে হবে। কেমন তাদের প্রস্তুতি এবং নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে তাদের প্রচেষ্টাগুলো বর্তমান রাজনীতির একটা মূল আলোচ্য বিষয়। এনসিপি জন্মের পর ধরে নিয়েছিল, তারাই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল এবং চ্যালেঞ্জ করবে বিএনপিকে। সে পরিপ্রেক্ষিতে জন্মের পর থেকেই এনসিপি বিভিন্নভাবে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। তারা মনে করেছিল, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে এনসিপি বিএনপির বিরুদ্ধে বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

এনসিপি ও জামায়াতের সহযোগিতায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছে জামায়াত। তাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকাকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিবিরকে এনসিপির পরিপূরক হিসেবে ভোট দিয়েছেন। এনসিপি সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতাদের অপরিপক্বতার জন্য বেশি দূর এগোতে পারেনি। কিছু নেতার ব্যক্তিগত প্রভাবের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রইল।

এনসিপির সংস্রবে ও নিজেদের সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় জামায়াত দ্বিতীয় দল হিসেবে বিরাট ‘বুস্ট’ পেল। এনসিপি এখন হয়তো বুঝতে পারছে যে জামায়াত দ্বিতীয় দল হিসেবে তাদের গ্রাস করেছ, তারা এখন বড়জোর দূরতম তৃতীয় দল। আরেকটি পরিবর্তন রাজনীতিতে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। ডাকসু-রাকসু নির্বাচনে হারার পর হঠাৎ রাজনীতির পুঁজিবাজারে বিএনপির বেশ ধস নেমেছিল। এখন বিএনপি তা কাটিয়ে আবার শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘ইতিহাসে দায় আছে, এমন কারও সঙ্গে জোটে যেতে অনেক ভাবতে হবে।’ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সরাসরি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত কখনো বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এনসিপি কি তবে বুঝতে পারছে যে জামায়াতের সঙ্গে থাকলে তাদের লোকসান আরও বাড়বে। এনসিপি সম্ভবত ক্ষমতার কাছেই থাকতে চায় এবং দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, তারা এখন বিএনপির সঙ্গে সমঝোতাকে অগ্রাধিকার দিতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো, ধানের শীষে শাপলা কলি ফোটার সম্ভাবনা কতটুকু? এই মুহূর্তে বিষয়টা অস্পষ্ট। কেননা, এনসিপি নেতা নাহিদ-আখতার-হাসনাত-সারজিসরা যেসব আসনে ভোট করতে চান, সেগুলোয় এর মধ্যেই বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। পক্ষান্তরে জাসদ, গণসংহতি, গণ অধিকার ও মান্নাদের আসনগুলো বিএনপি উন্মুক্ত রেখেছে। এ ছাড়া বিএনপি এখন এনসিপির বাইরে ‘জুলাই চেতনার’ তরুণ মুখ খুঁজছে। জুলাই শহীদ মুগ্ধর ভাই স্নিগ্ধর বিএনপিতে যোগ দেওয়া কাকতালীয় নয়।

অন্যদিকে সংবাদপত্রে বের হয়েছে, সমঝোতা করে নির্বাচন করার শর্ত হিসেবে এনসিপি বিএনপির কাছে ২০টি আসন ও ৩টি মন্ত্রিত্ব চেয়েছে। এ নিয়ে বিএনপির ভাষ্য পাওয়া যায়নি। এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম অবশ্য এ খবর অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, তাঁরা ৩০০ আসনেই লড়বেন। এ দুইয়ের কোনটি বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। তা ছাড়া রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। আমরা বরং আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাই।

সমঝোতায় দুই দলের লাভ-ক্ষতি

জোট বা সমঝোতা হলে এবং বিএনপি যদি নির্বাচনে জয়লাভ করে, তবে এনসিপির লাভ সহজেই অনুমান করা যায়। তারা তাদের রাজনীতির বর্তমান মডেলমতো কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। সরকারে তাদের লোক থাকবে, সংসদে থাকবে কয়জন সংসদ সদস্য এবং প্রয়োজনে তারা বাইরের থেকেও চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখবে। সরকারে শরিক হলে এনসিপির দৃশ্যমানতা বাড়বে এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি দৃশ্যমান হবে, যা তাদের দলের পরিধি বাড়াতে সহায়তা করবে। বিএনপির কি লাভ হবে? বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, বাংলাদেশি নিয়মে তারা বড়জোর এক মাস শান্তিপূর্ণ সময় পাবে—পশ্চিমা গণতন্ত্রে যাকে বলে ‘হানিমুন পিরিয়ড’।

এনসিপি যদি বিরোধী দলে থাকে, বিএনপির সম্ভাব্য সরকারের বিরুদ্ধে জামায়াতের আন্দোলন আরও তীব্রতর হবে। তাতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও খুব স্বস্তি পাবে না। জুলাই আন্দোলন একটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত করেছে যে বিরোধী দলকে লাঠিপেটা বা জেল–জুলুমে ঠেকানো সহজ নয়।

এনসিপির জন্য এ নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। তাদের মনে হয় একটু ধৈর্য ধরতে হবে। এনসিপি নেতাদের যে বয়স, তাঁরা আরও ৫০ বছর বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবেন। ক্ষমতায় আসতে জাসদের মতো তাড়াহুড়া না করে তাঁদের রাজনীতির ইতিবাচক গুণাবলি চর্চা করতে হবে।

এনসিপির সঙ্গে জোট করলে বিএনপির কী ক্ষতি হবে? স্বল্পমেয়াদি সমস্যা হবে, সরকারের মাঝে আবার সরকার থাকবে। অনেক কাজেই এনসিপি বিএনপিকে দারুণ চাপে ফেলবে এবং এনসিপির ‘ছোটরা’ বড় বড় দাবি জানাবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে যে ক্ষতি হতে পারে তা হচ্ছে, সরকারে থেকে এনসিপি তাদের দলের ভাবমূর্তি ও পরিধি আরও বাড়াতে পারবে। পরের নির্বাচনে হয়তো জামায়াতকে ডিঙিয়ে তারাই দ্বিতীয় শক্তিশালী দল হিসেবে বিএনপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ভবিষ্যতে দ্বিতীয় দল হিসেবে জামায়াতের চেয়ে এনসিপি বিএনপির জন্য বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

এনসিপির জন্য এ নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। তাদের মনে হয় একটু ধৈর্য ধরতে হবে। এনসিপি নেতাদের যে বয়স, তাঁরা আরও ৫০ বছর বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবেন। ক্ষমতায় আসতে জাসদের মতো তাড়াহুড়া না করে তাঁদের রাজনীতির ইতিবাচক গুণাবলি চর্চা করতে হবে।

 শুধু ‘জুলাই চেতনা’ দিয়ে তাঁরা বাড়তি কোনো সুবিধা পাবেন না। ‘রাজনীতিবিদদের’ মতো রাজনীতি করে তাঁরা অন্যদের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য জনগণকে বোঝাতে পারবেন না এবং চাপের রাজনীতি জনগণ পছন্দ করে না। এনসিপি এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলে নিশ্চয় আগামী নির্বাচনগুলোয় ভালো ফল পাবে।

  • সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

    salehpublic711@gmail.com

    *মতামত লেখকের নিজস্ব