পালাকার আবুল সরকার
পালাকার আবুল সরকার

মতামত

আবুল সরকার: বিচারগানের এ কেমন বিচার

বিচারগান আমাদের সংস্কৃতির একটি অসাধারণ অঙ্গ। কোনো একটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ তর্কে মাতে দুই পক্ষ, কথা বলে, গানে গানে প্রশ্নের উত্তর দেয়, নতুন প্রশ্নও তোলে। এভাবে আলাপে আলাপে শরিয়ত-মারফত, জীবাত্মা-পরমাত্মা, নারী-পুরুষ, গুরু-শিষ্য—বিবিধ বিষয়ে শ্রোতারা পক্ষ আর বিপক্ষের যুক্তিগুলোর সঙ্গে পরিচিত হন।

গুরুগম্ভীর তত্ত্বের আলাপ সেখানে যে ভঙ্গিতে উত্থাপিত হয়, সমবেতমণ্ডলী তাতে কখনো হেসে ফেলেন বা কখনো গভীর চিন্তায় মগ্ন হন। গায়কেরা সেখানে চর্বিতচর্বণ উপস্থাপন করেন না, নতুন নতুন ভাবনার খোরাক দিতে না পারলে তিনি আকর্ষণ হারাবেন। ফলে মুখস্থ করা কথা আর রপ্ত করা সুর আদৌ যথেষ্ট নয়; সংগত কারণেই বিচারগানের কিংবদন্তিরা নিজেরাও একেকজন মৌলিক ভাবুক। গুরুর সঙ্গে থেকে থেকেই শিষ্যরা রপ্ত করেন তাঁদের কৌশল।

বিচারগান উপস্থাপন কৌশল যেমন, একই সঙ্গে তা বুদ্ধিবৃত্তিরও চর্চা। আরবি-ফারসি সংস্কৃত–ঐতিহ্য থেকে আসা পরিভাষা ও ভাবনার ছড়াছড়ি সেখানে—নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁরা হাতড়ে বেড়ান তামাম দুনিয়া।

হাঙ্গামা যে লাগত না, তা নয়। সবচেয়ে বেশি হাঙ্গামা শরিয়ত-মারফত নিয়ে। শরিয়তে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে একটা পর্যায়ের পর ভাবারও অনুমতি নেই ধর্মীয় নির্দেশনায়। কিন্তু এর পরও মানুষের মন কি মানে! ভাবনার এই প্রেরণাও তো অনেকে পান ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে।

জগতের অসীমতা উপলব্ধি করতে এই মানবিক সীমাবদ্ধতা নিয়েই অসীমের ভাড়ারে উঁকি দেওয়ার যে চেষ্টা শতকের পর শতক ধরে বাংলার ভাবুকদের মধ্যে চলমান, বিচারগানে তারই ধারাটি বয়ে চলেছে। আবুল সরকার তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার দিনেও গানে গানে যখন বলেন—

‘দয়ালরে, ও দয়াময়

তুমি জুড়িয়াছ পুতুল খেলা

আমার তাতে কিসের জ্বালা

পরাজয় কি জয়ের মালা

পরাও তোমার মন মতন

তবে কেন দোষী আমি

ওহে প্রভু নিরঞ্জন’

এই গানের মাঝে সেই বিস্ময়ই আছে, যে বিস্ময়ে আরবের ‘জাবারিয়া’ আর ‘কাদারিয়া’রা মানবভাগ্য পূর্বনির্ধারিত কি না, নির্ধারিত হলে মানুষের পাপ–পুণ্যের বিচার কীভাবে সম্ভব—সেই তর্কগুলো করেছেন। ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও জ্ঞানের এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা চান মানুষ। বিচারগানে আসলে চির অমীমাংসিত সেই বিষয়গুলো নিয়েই নিত্য আলোচনা হয়। তর্কযুদ্ধে প্রশ্নের ছলে পরস্পরকে ঠেস দেওয়া, শ্লেষ করা চলে, কখনো কখনো তর্ক চলে যায় উষ্মার পর্যায়ে—কিন্তু বহুবার দেখেছি দুই বিবদমান পক্ষ বিচার শেষে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে, প্রশংসা করে, শ্রদ্ধা জানায়।

দর্শক শ্রোতাদের মনেও কি এই তর্কশেষের মিলনের অনুভূতিটা গভীরভাবে কাজ করে না? অজস্র প্রশ্ন আর ভাবনা নিয়ে তাঁরা বাড়ি ফেরেন, প্রশ্ন আর জবাবগুলো ছড়িয়ে দেন গ্রামান্তরে, নতুন নতুন প্রশ্ন আর জবাবও তৈরি করেন নিজের জন্য।

এই তো আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে সহিষ্ণুতার ভিত্তি!

পালাগানের আসরে আবুল সরকার

২.

আবুল সরকারের কথাই বিশেষভাবে বলা দরকার। বিচারগানের দর্শকেরা তাঁর মৃদু হাসি, পরিহাসের শক্তি আর অন্য পক্ষের ঠেসও হাসিমুখে শুনার দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত। তাঁর ওস্তাদরা সবাই কিংবদন্তি ছিলেন, তিনিও ইতিমধ্যেই তাই; কিন্তু আবুল সরকারের গভীরতম পরিচয়টা মেলে গানের ভক্তিমূলক অংশে। দয়ালের দর্শনের জন্য ব্যাকুল কণ্ঠে মঞ্চজুড়ে যে নিবিষ্টতা তিনি তৈরি করেন, তার ঘোর আকর্ষণে অজস্র মানুষ তাদের গানের আয়োজনগুলোতে যান, ক্যাসেটের যুগে সংগীতশিল্প টিকে ছিল তাদের বিক্রির ওপরই ভর করে, এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে তাদের শ্রোতাদের সংখ্যা দেখলে যে কেউ অবাক হবেন।

সেই আবুল সরকারের বিরুদ্ধে যখন ‘ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসের অবমাননা করে এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কটূক্তি করে এবং অট্টহাসি দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে উসকানি দেওয়ার অপরাধ’ প্রভৃতি অভিযোগ আনা হয় এবং আবুল সরকার গ্রেপ্তারও হন, তাঁর জামিন না মঞ্জুর হয়, তখন রাষ্ট্র যে ‘অট্টহাস্যের স্তরে’ নিজেকে পৌঁছে দেয় কি না, সেই বিচারের সময় আসে না?

দুটি বিষয় খুব পরিষ্কার করে বলে রাখা দরকার। এক হলো, আবুল সরকারের নেশা ও পেশা সংগীত। গ্রামীণ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীই তাঁর শ্রোতা। ফলে সহজ যুক্তিতেই বলা যায়, ধর্মের অবমাননা করে আবুল সরকারের পক্ষে কি একটা দিনও মঞ্চে গান গাওয়া সম্ভব?

দ্বিতীয় বিষয় হলো, আবুল সরকারের ধর্মপ্রাণ শ্রোতাগোষ্ঠী তাঁর গানে ধর্মের অবমাননা দেখতে পাননি, সেই কাজ কেন পুলিশ বা আদালত করতে যাবে, তৃতীয় একজন ব্যক্তির কথায়? অভিযোগ যে কেউ করতে পারেন, কিন্তু অবমাননা ইত্যাদি মামলায় গ্রেপ্তার ও জামিন না দেওয়ার যে হয়রানি, সেটি আমাদের বিচারিক ব্যবস্থার একটা ভয়াবহ দিক। হাসিনার আমলেও রীতা দেওয়ান একইভাবে দিনের পর দিন কারাগারে বন্দী থেকেছেন, নিছক গান গাওয়ার অপরাধে। সেই দৃষ্টান্তই কেন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও অনুসরণ করা হলো?

পালাগানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার আবুল সরকার।

৩.

কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে বিচারগান এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটা বিশাল ফাটলের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশে আগেও তা ছিল, কিন্তু গত আগস্টের অভ্যুত্থানের পর সংঘবদ্ধ দঙ্গলবাজি একটি বিশাল রাজনৈতিক কৌশল আকারে দেখা দিয়েছে। মাজারে হামলা, ভাঙচুর, নারীর ওপর হামলা ইত্যাদি অজস্র ঘটনা ঘটছে এবং এগুলো ঘটেছে ‘তৌহিদি জনতা’ ইত্যাদি নামের আড়ালে; হামলাগুলোর লক্ষ্য ধর্মের বা শালীনতার একটি মাত্র ব্যাখ্যাকে বৈধতা দেওয়া, বাকিদের যথাসম্ভব নিষিদ্ধ করা।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী শরিয়তি বা মারফতি যে ধারারই হোক না কেন, পরস্পরের প্রতি সাধারণত শ্রদ্ধাই ছিল তার ঐক্যের শক্তি। ফলে বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ধর্মীয় সংঘাত এখানকার ঐতিহ্য ছিল না। গত কয়েক দশকে প্রভাব বিস্তার করা ধর্মীয় মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সনাতনী হানাফি, পীরপন্থী কিংবা তরিকতপন্থী নানা ধারার কিছু সমস্যা দেখা দিলেও সেগুলো সাধারণত বেশ সীমিত সময় ও সীমিত অঞ্চলের বিষয় ছিল।

মানিকগঞ্জের ঘটনার কয়েকটি উদ্বেগজনক প্রতিক্রিয়া সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে দেখেছেন, ‘একটা একটা বাউল ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর/জেলে ভর’ ইত্যাদি স্লোগান দেওয়া মিছিল, মানিকগঞ্জে বাউলদের ওপর সংঘবদ্ধ হামলা, একটি ভিডিওতে আহত বাউলদের একজনের মুখে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের দিয়ে তাঁদের ওপর হামলা করার অভিযোগ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাউলদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং তাঁদের হত্যাযোগ্য করার মতো নানা বক্তব্য ইত্যাদি এবং বাউলদের ওপর হামলা বন্ধে প্রশাসনের সম্পূর্ণ নীরবতা, অনির্দিষ্ট ‘অট্টহাসির অভিযোগে’ আবুল সরকারকে রাতারাতি গ্রেপ্তার করা হলেও বাউলদের ওপর সুনির্দিষ্ট হামলাকারী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে আদৌ তৎপরতা না দেখানো।

এটা থেকে একটা সংশয় জাগে যে ভারতের বিজেপির ব্যবহৃত সফল নির্বাচনী কৌশল অনুসরণ করে বাংলাদেশে সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদী দলগুলো নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন এবং প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য দঙ্গলবাজিকে একটা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত করবে।

সেটি না করার কারণ দেখি না। এখন পর্যন্ত তারা সফল।

এখনকার তরুণদের একটি বড় অংশ শুধু যে কখনোই পালাগানের সঙ্গে পরিচিত নন, তা–ই না, এর প্রতি একটি তীব্র বিদ্বেষ ও বিরূপ সমালোচনা শুনেই তাঁরা বড় হয়েছেন। এরপরও কিন্তু এর গুণগ্রাহীর সংখ্যা নগণ্য নয়। তবে দঙ্গলবাজির বিপরীতে সংগঠিত হওয়ার সামর্থ্য এখনো কম; কিন্তু এখনো নিম্নমধ্যবিত্ত বসতিগুলো দিয়ে এগুলো কোনো না কোনো জানালায় পালাগান-বিচারগান কিংবা এমন আর কোনো সংগীত শুনতে পাই, যেগুলোর জন্ম বাংলার কৃষিসভ্যতার গহনে।

৪.

আবুল সরকারের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীকে দায়ী করেছেন। ফারুকী এর ব্যাখ্যায় স্পষ্ট করেছেন, বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পড়ে। এরপরও তিনি নিজে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন।

তবে দুঃখজনকভাবে তাঁর পুরো লেখায় একবারও বাউলের ওপর হামলার প্রতিবাদ, নিন্দা কিংবা রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে এই বিষয়ে তাঁর অবস্থান নিয়ে কোনো স্পষ্ট বার্তা নেই। যাঁরা তাঁকে অনেক দিন ধরে চেনেন, তাঁরা হয়তো একটা কিছু ভেবে নেবেন; কিন্তু বাউলদের ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণ বিষয়ে, দঙ্গলবাজির বিষয়ে তাঁর কোনো মতামত তিনি প্রকাশ করেননি বলে তাঁকে না চেনা মানুষেরা হয়তো জানবেন না তাঁর অবস্থানটা কী। জানা থাকলেও তো তা এই দুঃসময়ে বলা দরকার।

সন্দেহ নেই যে নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়, যেমনটা সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেছেন। কিন্তু ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে যদি একজন পরিচালক বা শিল্পী গ্রেপ্তার হন, তাঁরা কি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে ফারুকী ভাইকে পাশে পাবেন?

সংস্কৃতি উপদেষ্টা হিসেবে সব শিল্পীর শৈল্পিক স্বাধীনতা রক্ষার দায় সংস্কৃতি উপদেষ্টা এড়াতে পারেন?

আবুল সরকারের মুক্তি দাবির কর্মসূচিতে তাঁর অনুসারীদের ওপর হামলা।

৫.

একটি বিষয় আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। গায়ক বা বাউলদের ওপর হামলাতেই এটা সীমিত নেই। প্রায় প্রতিটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল অন্য দলগুলোর আকিদাকে ভ্রান্ত, কাফের বা এমন কিছু বলে আসছে। তাবলিগ জামাতও এই রকম দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়েছে, তার পেছনে একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছে ধর্মপ্রচারকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা বিষয়ক কিছু ধর্মীয় বয়ানের ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব, যা ইতিমধ্যে প্রাণহানি ও সাংবাৎসরিক সংঘর্ষের কারণ ঘটাচ্ছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখলাম শক্তিশালী এই পক্ষগুলো পরস্পরকে কম ঘটাচ্ছে, তাদের সবার সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পড়ছে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল তরিকতপন্থীরা ও বাউল-ফকির সম্প্রদায়।

নব্বইয়ের দশকেও এই ঢাকা শহরে কবিগান, পালাগান ও বিচারগানের আসর বসত। আগারগাঁওয়ের ফাঁকা মাঠে সম্ভবত ১৯৯৮ সালেও বড় আকারে কবিগানের আসর দেখেছি। পোশাকশ্রমিক, বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা ছিলেন প্রধান দর্শক। আমরা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া পাস দিয়ে যেতে গিয়ে বুঁদ হয়ে শুনেছি। সেবারই প্রথম মমতাজকে দেখি নারী-পুরুষ পালায় তাঁর দরাজকণ্ঠে প্রতিপক্ষকে ‘তুমি নারীর সন্তান হইয়া নারীরে হেয় করো পুরুষ পক্ষ লইয়া’ বলে ঠেস দেওয়াটা এখনো আবছা মনে পড়ে।

এর বাজার ও আয়োজন যে ক্রমে সংকুচিত হয়েছে, তা ভোক্তার অভাবে ততটা না, যতটা শহুরে শিক্ষিত ব্যক্তিদের এই প্রশ্নগুলোকে অস্বস্তিকর বোধ করার এবং অনেকটাই তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ মোল্লাতন্ত্রের চাপে। পালাগান বা বিচারগানের যাঁরা শ্রোতা, তাঁদের রাজনৈতিক প্রকাশ শহরের আন্দোলনে কখনোই হয়নি, গ্রামেও তাঁরা বহুস্থানেই কোণঠাসা হয়েছেন।

এখনকার তরুণদের একটি বড় অংশ শুধু যে কখনোই পালাগানের সঙ্গে পরিচিত নন, তা–ই না, এর প্রতি একটি তীব্র বিদ্বেষ ও বিরূপ সমালোচনা শুনেই তাঁরা বড় হয়েছেন। এরপরও কিন্তু এর গুণগ্রাহীর সংখ্যা নগণ্য নয়, তবে দঙ্গলবাজির বিপরীতে সংগঠিত হওয়ার সামর্থ্য এখনো কম; কিন্তু এখনো নিম্নমধ্যবিত্ত বসতিগুলো দিয়ে এগুলো কোনো না কোনো জানালায় পালাগান-বিচারগান কিংবা এমন আর কোনো সংগীত শুনতে পাই, যেগুলোর জন্ম বাংলার কৃষি সভ্যতার গহনে।

সংস্কৃতির যে ফাটলগুলো আমাদের জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করেছে, পরস্পরের সাংস্কৃতিক জগৎকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করেছে, তার একদিকে বিবিধ টানাপোড়েনসমেত আধুনিক মধ্যবিত্ত—যার সঙ্গে বাকিদের পরিচয় নিতান্তই সামান্য, অন্যদিকে বিশাল ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী—যার পেশাগত ও ধর্মীয় টানাপোড়েন আরেক রকম এবং তৃতীয় একটি দিকে গ্রামীণ ও শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী—নানাভাবেই যে এখনো ধরে রেখেছে, এই ঐতিহ্যবাহী সম্পদ; গভীর এই ফাটল মেরামতের সাংস্কৃতিক ও সবচেয়ে কম নির্বিবাদী প্রক্রিয়া কী হতে পারে, সেটি নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার। তা না হলে লালনকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক বড় আয়োজন হতে থাকবে, আরেক দিকে লালনের উত্তরসূরিরা স্রেফ দঙ্গলবাজির শিকার হয়েই অপস্রিয়মাণ হয়ে যাবেন।

আমার চেনা দুজন আলেম আবুল সরকারের পুরো পালাটা শুনে বলেন, এর মধ্যে ইসলামবিরোধী গুরুতর কিছু তো নেই! একজন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ফেসবুকে দেখলাম অনুরোধ করেছেন, আবুল সরকারের এই পালা নিয়ে যেন মানিকগঞ্জের সংশ্লিষ্ট আলেমদের বসানো হয়, কারণ, তিনিও পুরোটা শুনে বুঝতে পারছেন, এটা ভুল–বোঝাবুঝি!

বিবদমান শিবিরের একজন–দুজন আলাদা করে বুঝতে পারলে কিন্তু এই বিপদ কাটবে না। কিংবা মহারাজ আবুল সরকারের গান গাওয়ার, তর্ক করার অধিকার কেন কতিপয় ব্যক্তির বোঝা-না বোঝার ওপর নির্ভরশীল থাকবে? তাই এই বিচ্ছিন্নতা ঘোচানোর উপায় যেমন বের করতে হবে, তেমনি গান গাওয়ার অধিকারটিকেও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

  • ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও সংগঠক। ই–মেইল: firozdhakauttara@gmail.com

    * মতামত লেখকের নিজস্ব