নির্বাচনের সময় ঠিক হয়ে গেছে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরু হওয়ার আগেই কাঙ্ক্ষিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা আশার বাণী শুনিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কমিশন সময়মতো তফসিল ঘোষণা করবে। আমরা শিগগিরই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ জানতে পারব। তারপর শুরু হবে ক্ষণগণনা।
নির্বাচনের গন্ধ নাকে এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর গা গরম হয়। চারদিকে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। যত্রতত্র পোস্টার-ব্যানার-তোরণ, মাইক্রোফোনের কানফাটা আওয়াজ, গাড়িবহর নিয়ে মিছিল, রাস্তা আটকে জনসমাবেশ, মঞ্চে আস্তিন গুটিয়ে আস্ফালন, ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনয়ের অবতার সেজে ভোটভিক্ষার অভিনয়, এসব চলবে দিনের পর দিন। যে দল নাগরিকদের যত বেশি কষ্ট দিতে পারবে, সে দল তত বড়, তত শক্তিশালী। তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। তবে তারা অনেকেই পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলছে। হম্বিতম্বি করছে।
ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ করা ঐকমত্য কমিশন খসড়া সংস্কার প্রস্তাব প্রকাশ করেছে। সব দল সব প্রস্তাবে একমত নয়। রাজনৈতিক মহলে দুটি মত বেশ প্রবল। একটি মত হলো সব বিষয়ে ঐকমত্যের আশায় বসে না থেকে অবিলম্বে নির্বাচনটি হয়ে যাক। অন্য মতটি হলো, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হবে না। তারা শুধু এটি বলেই ক্ষান্ত হয়নি। বলেছে, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। আপাতদৃষ্টে দুই মতের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ মীমাংসার সম্ভাবনা নেই।
তবে এ দেশে অনেক কিছুই হয়। রাজনৈতিক ডিগবাজিতে পারঙ্গম নেতারা যেকোনো মুহূর্তে মত বদলাতে পারেন। সেটির জন্য তাঁরা যুক্তিগুলো তৈরি করেই রাখেন। এই যেমন জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমরা আপাতত এটা মেনে নিলাম; কিংবা ক্ষমতার প্রতি আমাদের কোনো লোভ নেই, আমরা রাজনৈতিক শূন্যতা চাই না; কিংবা আমাদের কাছে নির্বাচন হচ্ছে আন্দোলনেরই একটি ধাপ ইত্যাদি।
এটা বা ওটা না হলে নির্বাচন প্রতিহত করা হবে বলে যাঁরা হুংকার দিচ্ছেন, তাতে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। তবে এটা ঠিক, সরকার যদি চায় তাহলে যত প্রতিবাদ-বিরোধিতা থাকুক না কেন, নির্বাচন করিয়ে নিতে পারে। যেমন আমরা দেখেছি ১৯৮৮ সালে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে এবং ২০১৪ সালে। যেহেতু কাগজে-কলমে এটি পার্টিজান সরকার নয়, সে জন্য কোনো মহলের তুমুল বিরোধিতার মুখে একটা নির্বাচন করিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল অন্যদের প্রতিপক্ষ মনে করে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। অনেকের মুখেই লাগাম নেই। তাঁরা যা খুশি বলছেন। মনে হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে একটা দাঙ্গা বা যুদ্ধ বেঁধে যাবে। আসলেই কি তা?
আমার মনে হয় এসব গা-গরম করা কথাবার্তা আমাদের দেশের রাজনীতির একটা বৈশিষ্ট্য। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, তাদের আস্ফালন ততই বাড়বে। আমরা এটাকে বলি ‘প্রেশার ট্যাকটিকস’। প্রতিপক্ষকে চাপে রেখে সুবিধা আদায় করে নেওয়ার সনাতন কৌশল। নেপথ্যে আরেকটা কাজ হয়—প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে দর-কষাকষি। ছোট ও নাজুক দলগুলো বড় দলের কাছে হিস্যা চায়। বড় দল ছোট দলকে কিছু তালুক বরাদ্দ দিয়ে তাকে নির্বিষ করতে চায়। উভয়ের জন্য একটা ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি তৈরি হয়। এটা একটা খেলা।
আমরা কিছু নির্বাচনকে ভালো বলি আর কিছু নির্বাচনকে খারাপ বলি। এটা অনেকটা নির্ভর করে নির্বাচন উপলক্ষে আসা বিদেশি পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদন ও মন্তব্যের ওপর। আমাদের নির্বাচন ভালো হলো কি হলো না, তার রায় দেন বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা। দেশি পর্যবেক্ষকদের মতামতের তেমন ওজন নেই। কারণ, তাঁরা বেশির ভাগই পর্যবেক্ষণ করেন বিদেশিদের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে। ব্যাপারটা মোটেও সম্মানজনক নয়।
দেখা যায়, ওপরে ওপরে কথার ফণা তুলে ছোবল মারছে আর তলেতলে আসন ভাগাভাগির বৈঠক করছে। একটা রফা হয়ে গেলেই সাপের ফণা নেমে আসে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ একটা কথা বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলের নেতারা সারা দিন আমাকে গালি দেয়, আর রাত হলেই গোপনে আমার সঙ্গে বৈঠক করে টাকা নিয়ে যায়।’ এরশাদ কীভাবে রাজনীতিবিদদের ম্যানেজ করে চলতেন, সেসব কেচ্ছা অনেকটাই জানা, আর অনেকটাই এখনো অজানা। ব্যবসা দিয়ে, টাকাপয়সা ছড়িয়ে, হানি ট্র্যাপে ফেলে তিনি যে কতজনকে বাগে এনেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। এরশাদের এই মডেলটির কার্যকারিতা ফুরিয়ে যায়নি।
এর মধ্যে সরকার দুটি জিনিস ছুড়ে দিয়েছে। একটি হলো জুলাই ঘোষণাপত্র, অন্যটি জুলাই সনদ। কেউ বলছেন, নির্বাচিত সরকার এসে এগুলো সংবিধানে ঢোকাবে। কেউ বলছেন, নির্বাচিত সরকারই ঠিক করবে, কোনটি তারা গ্রহণ করবে আর কোনটি বাদ দেবে। বাদ দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কিছু কিছু বিষয়ে কোনো কোনো দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা আপত্তি তোলায়। তারা যদি সরকার গঠন করে, তাহলে আপত্তি জানানো বিষয়গুলো মেনে চলার বাধ্যবাধকতা তাদের থাকে না।
তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াল? এই যে এত আন্দোলন, এত রক্ত, এত মৃত্যু, এত ধ্বংস, এসবের কি কোনো দাম নেই? রাষ্ট্র মেরামত হবে না?
এ তো গেল রাজনৈতিক দলগুলোর কথা। দেশে মানুষ আছে ১৭ কোটির বেশি। ভোটার আছেন ১২ কোটির মতো। তাঁদের অনেকেই নির্বাচন দেখেছেন। এর আগে এ দেশে ১২টি নির্বাচন হয়েছে। ‘নির্বাচিত’ সরকার ছয়বার মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে। এর মধ্যে তিনবার পূর্ণ মেয়াদে ছিল কূটকৌশল আর জবরদস্তি করে। সুতরাং আরেকটা নির্বাচন হলেই যে সেটি পূতপবিত্র হবে এবং সরকার টেকসই হবে, তার কী নিশ্চয়তা আছে।
অতীতে এ দেশে এমন কোনো নির্বাচন হয়নি, যেটা কোনো না কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্র এমনই যে সেখানে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থেকেই যায়।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেরা পরিচ্ছন্ন না হয়, ভোটারদের ওপর জবরদস্তি না করে, নির্বাচনের দিন তাদের লোকেরা যদি ভোটের বাক্স মাথায় নিয়ে দৌড় না দেয়, তাহলে তো এত কিছুর দরকার হয় না। যেনতেনভাবে জিততে হবে, এই ভাবনার মাশুল দিতে হয় নাগরিকদের
তারপরও আমরা কিছু নির্বাচনকে ভালো বলি আর কিছু নির্বাচনকে খারাপ বলি। এটা অনেকটা নির্ভর করে নির্বাচন উপলক্ষে আসা বিদেশি পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদন ও মন্তব্যের ওপর। আমাদের নির্বাচন ভালো হলো কি হলো না, তার রায় দেন বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা। দেশি পর্যবেক্ষকদের মতামতের তেমন ওজন নেই। কারণ, তাঁরা বেশির ভাগই পর্যবেক্ষণ করেন বিদেশিদের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে। ব্যাপারটা মোটেও সম্মানজনক নয়।
নির্বাচন নিয়ে এই যে এত অভিযোগ—সূক্ষ্ম কারচুপি, স্থূল কারচুপি, পুকুরচুরি, সাগরচুরি, এ থেকে আমরা মুক্ত হব কবে? যত দিন না মুক্ত হতে পারছি, তত দিন আমরা নানা সংস্কারের কথা বলেই যাব; নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্ত শক্ত আইন বানাতে বলব; সেনাবাহিনী নিশ্ছিদ্র পাহারা বসাবে সব ভোটকেন্দ্রে। অঘটনের দৈত্যগুলোকে বোতলে পুরে স্বস্তি পাব। নির্বাচনের পর দেখা যাবে, বোতলের ছিপি খুলে সব দৈত্য বেরিয়ে এসেছে। তারপর আবার আন্দোলন। এই তো চলছে চক্রাকারে।
সংস্কারের নামে যে প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করা হয়েছে, সেসবের লক্ষ্য হচ্ছে একটা গ্রহণযোগ্য ও টেকসই নির্বাচনব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং তার মাধ্যমে একটি দায়িত্বশীল সরকারব্যবস্থার পত্তন। ন্যূনতম সংস্কার না করে আরেকটি নির্বাচনে যাওয়ার অর্থই হলো ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।’ সংস্কারের ব্যাপারে যাঁরা আন্তরিক নন, তাঁরা পুরোনো বন্দোবস্তেই দেশ চালাতে চান।
তবে সংস্কার জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। ভেতর থেকে সংস্কারের উপলব্ধি আসতে হয়। সাধারণ মানুষ চাইলেই হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেরা পরিচ্ছন্ন না হয়, ভোটারদের ওপর জবরদস্তি না করে, নির্বাচনের দিন তাদের লোকেরা যদি ভোটের বাক্স মাথায় নিয়ে দৌড় না দেয়, তাহলে তো এত কিছুর দরকার হয় না। যেনতেনভাবে জিততে হবে, এই ভাবনার মাশুল দিতে হয় নাগরিকদের।
নির্বাচন নিয়ে দলগুলো শক্তির মহড়া দেয়, প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে যায়, খুনোখুনি হয়, ভোট না দেওয়ার ‘অপরাধে’ ভোটারের বাড়ি পোড়ানো হয়, ধর্ষণের শিকার হয় নারী। নির্বাচনী সহিংসতাকে দেখা হয় একটি নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে সারা দেশ ছেয়ে দিতে হয়, নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকায় তাদের জন্য কেনা হয় হাজার হাজার গাড়ি ও যন্ত্রপাতি, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে লাগাতে হয় সিসি ক্যামেরা। আর কতকাল এভাবে পাহারা দিয়ে নির্বাচন করতে হবে? শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয়, ‘আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব