সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতি

নবায়নযোগ্য জ্বালানির হিস্যা বাড়াতেই হবে

বিগত সরকারের জ্বালানি খাতের ভুল নীতি ও দায়মুক্তি যে গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্যই চালু ছিল, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদন থেকে সেটা আরেকবার পরিষ্কার হলো। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বমুখী সূচি, সামাজিক অসন্তোষের পেছনে নিশ্চিত করেই জ্বালানি খাতের অবাধ লুটপাটের বড় অবদান আছে। টিআইবির গবেষণা জানাচ্ছে, গত ১৫ বছরে ছয়টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। গড়ে প্রতি মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যেখানে ৮ কোটি টাকা প্রয়োজন, সেখানে ৬টি প্রকল্পে গড়ে ১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।

টিআইবির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পিডিবির আইপিপি বিভাগের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত বিস্তৃত একটি নেটওয়ার্ক কীভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি সরকারি জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও সেখানে মেগাওয়াটপ্রতি উৎপাদন খরচ দেখানো হয়েছে ১৪ কোটি টাকা। শ্রেণি পরিবর্তন করে কৃষিজমিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়েছে, যোগসাজশের মাধ্যমে মৌজামূল্যও বেশি দেখানো হয়েছে। এখানে একদিকে যেমন আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে, আবার কৃষি উৎপাদনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় চার গুণ বেশিতে চুক্তি করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়নি।

এ দুর্নীতি ও অনিয়মের সবটাই করা হয়েছে ২০১০ সালের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ আইন) আইনের অপব্যবহার করে। অন্তর্বর্তী সরকার জ্বালানি খাতের দায়মুক্তি আইন বাতিল করলেও জ্বালানি খাত সংস্কারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে অবশ্যই জ্বালানি খাতকে অতীতের ভুল নীতির খেসারত থেকে টেনে তুলতে হবে।

বাংলাদেশে যে জ্বালানির চাহিদা, তার ৯৫ শতাংশের বেশি জোগান আসে জীবাশ্ম জ্বালানি বা কয়লা, গ্যাস ও তেল থেকে। আমাদের জ্বালানির যে মহাপরিকল্পনা, সেটা জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। শুধু জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে একটি স্বনির্ভর, টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী জ্বালানিব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এটা সত্যি যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে একলাফেই আমাদের পক্ষে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরিত হওয়া যাবে না। কিন্তু জ্বালানি রূপান্তরের সুস্পষ্ট পথনকশা থাকতে হবে, ধাপে ধাপে নবায়নযোগ্য জ্বালানির হিস্যা বাড়াতে হবে।

ফলে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সময় এসেছে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে কেন্দ্রে রেখে নতুন করে জ্বালানি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা। বাতিল হওয়া কয়লা ও এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ইশতেহারে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দিয়ে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে তাদের পরিকল্পনা নাগরিকদের সামনে উপস্থাপন করবে।