সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

বিদায় খালেদা জিয়া

তাঁর ত্যাগ ও আপসহীনতা ইতিহাস মনে রাখবে

চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল মঙ্গলবার ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে জাতি তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করছে। এই মৃত্যু শুধু তাঁর দল বিএনপি নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি করল, তা অপূরণীয় বলে আমরা মনে করি। আমরা তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি।

রাজনৈতিক আন্দোলনে খালেদা জিয়া তাঁর নেতৃত্বের কারণে আগেই আপসহীন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তবে শেষ বয়সে সেটা ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জাতির ঐক্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের দুই দশক পর ১৯৯১ সালে নিরপেক্ষ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত বাস্তবিক অর্থেই বাংলাদেশের প্রথম অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে খালেদা জিয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি আরও দুই দফা প্রধানমন্ত্রী এবং দুই দফা সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে জেল, জুলুম, নির্যাতন ও ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির পরও খালেদা জিয়া যেভাবে তাঁর অবস্থানে অবিচল থেকেছেন, সেটাই নিশ্চিত করে দেশের মানুষ ও গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতিচ্ছবি।

১৯৮১ সালের ৩০ মে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। শুরু হয় তাঁর চার দশকের বেশি সময়ের রাজনৈতিক পথযাত্রা। প্রয়াত রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে তিনি বিএনপিতে মর্যাদার আসন পেলেও এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

সামরিক শাসক এরশাদের শাসনকে বৈধতা দেওয়া ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল বিএনপি অংশ নেয়নি। রাজনীতিতে আসার মাত্র ১০ বছরের মাথায় ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তাঁর দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন। বাংলাদেশের মতো একচেটিয়া পুরুষতান্ত্রিক আবহাওয়া এই অর্জন নানা দিক থেকে অনন্য। নিজের রাজনৈতিক স্বকীয়তা দিয়ে তিনি তা অর্জন করেছিলেন। বাংলাদেশকে রাষ্ট্রপতিশাসিত থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকারব্যবস্থায় রূপান্তরের ক্ষেত্রেও খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

খালেদা জিয়ার দীর্ঘ ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি নানা সময়ে সরকার ও বিরোধী দলে থেকেছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রাজনৈতিক কারণে বহু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অনেক সিদ্ধান্ত বিতর্ক ও সমালোচনারও জন্ম দেয়। আর সব রাজনৈতিক নেতার মতো খালেদা জিয়াও এর ঊর্ধ্বে নন।

খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির এমন এক সন্ধিক্ষণে বিদায় নিলেন, যখন তাঁর অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন ছিল আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিগত সরকারের দীর্ঘ স্বৈরশাসনের প্রতিফল হিসেবে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি বর্তমানে গভীরভাবে বিভক্ত ও মেরুকৃত। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসান ঘটলেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণযাত্রার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু গণতান্ত্রিক উত্তরণ নয়, বাংলাদেশের সমাজকে বিভাজনের চক্র থেকে বের করে আনাও দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য এ এক গুরুদায়িত্ব। বাংলাদেশের এই রূপান্তরকালীন সন্ধিক্ষণে খালেদা জিয়ার শূন্যতা জাতি প্রবলভাবে অনুভব করবে।

বিদায় খালেদা জিয়া। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর ত্যাগ ও আপসহীন ভূমিকা ইতিহাস দীর্ঘদিন মনে রাখবে।