সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

সংসদে নারী আসন

সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেন ন্যায্য হিস্যা পাবে না

জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা সামনের মুখ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের প্রান্তিক করে তোলার একটি চেষ্টা প্রবলভাবে দৃশ্যমান। নারীর অধিকার রক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। সংসদে নারী আসন ও নারীর মনোনয়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যে অবস্থান নিয়েছে, সেটা শুধু দুঃখজনকই নয়, সমাজের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বিকাশের পথেও বড় একটি ধাক্কা। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের জন্য আগের মতোই ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রাখার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য।

বাংলাদেশের জন্মের ৫৩ বছর পার হয়ে গেলেও রাজনীতিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব একেবারে তলানিতে রয়ে গেছে, আর সেই প্রতিনিধিত্বটাও আবার মোটাদাগে আলংকারিক। মুখে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যে চিন্তার দিক থেকে চরম রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক—এই বাস্তবতা তারই প্রতিফলন। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক কম।

রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণীর জায়গায় যে নিরঙ্কুশ পুরুষ আধিপত্য চলে আসছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একটা বড় সুযোগ ও পরিসর তৈরি করে দিয়েছিল চব্বিশের অভ্যুত্থান। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, নারীদের কথা না শুনেই নারীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে যে কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে, সেখানে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা নগণ্য। এমনকি ঐকমত্য কমিশনে কোনো নারী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপদ্ধতি কোনো অর্থেই গণতান্ত্রিক নয়। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটি একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হবে।

এটা ঠিক যে সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে এই হতাশাজনক অবস্থানের মূল দায় রাজনৈতিক দলগুলোর পশ্চাৎপদ ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং প্রথাগত চর্চা। তারা কোনোভাবেই নারীর জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে নারাজ। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন কেন রাজনৈতিক দলের অবস্থানকেই শেষ কথা বলে মনে করবে? আমরা মনে করি, এখানে ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল এবং সেই সুযোগ এখনো আছে।

আমরা দেখছি যে রাজনীতি ও সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন সংস্কার কমিশন আলাদা প্রস্তাব দিয়েছিল। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবকে ঐকমত্য কমিশন তাদের কাজের পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত করেনি। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন কমিশন পৃথক প্রস্তাবে নারীর জন্য ১০০টি সংরক্ষিত আসন ও সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সরাসরি ভোটে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে।

সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫১ শতাংশ নারী। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও নারী কেন ক্ষমতার ন্যায্য হিস্যা পাবে না? গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দলগুলো আসলে কী চর্চা করছে, সেই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? গত শনিবার প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক ‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে বয়েজ ক্লাব হিসেবে পার করে দেব, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটা যথার্থ বলে মনে করি।

গোলটেবিল বৈঠকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা শুধু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই জানাননি, তাঁরা সুস্পষ্টভাবে নারী আসন ও মনোনয়ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার কথাও বলেছেন। তাঁরা আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে ঐকমত্য কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

আমরাও মনে করি, নারী আসন ও নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে অধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে তা নিরসন করতে হবে। নারী প্রতিনিধিদের যুক্ত করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনকে আবারও আলোচনায় বসতে হবে। নীতিনির্ধারণীতে নারীকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণ থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি—কোনোটাই টেকসই হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে পুরুষতান্ত্রিক চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।