জননিরাপত্তা হুমকিতে 

কাগুজে পুলিশি টহল দিয়ে কী হবে

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সাড়ে পাঁচ মাস পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি তথা খুন, ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়া খুবই উদ্বেগের বিষয়। গত শুক্রবার অর্ণব কুমার সরকার নামে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পরদিন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মায়ের সামনে ইমরান হোসেন নামের আরেক তরুণকে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কী পর্যায়ে আছে।

গত বৃহস্পতিবার হাজারীবাগে স্বর্ণ ব্যবসায়ী সজল রাজবংশীকে গুলি করে ৭০ ভরি সোনা ও চার লাখ টাকা নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। গত সপ্তাহে রাজধানীর পল্লবীর টেকেরবাড়িতে দিনদুপুরে ১০ থেকে ১২ দুর্বৃত্ত মঞ্জুরুল ইসলাম বাবু নামের এক যুবককে চাপাতি ও ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ২১ জানুয়ারি রাতে ঢাকায় কুপিয়ে জখম করে দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এদিন দিবাগত রাত পৌনে ১২টায় বাড্ডায় দুজনকে কুপিয়ে টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে রাত পৌনে ৯টায় গুলশানে মানি এক্সচেঞ্জ (বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়) ব্যবসায়ীসহ দুজনকে কুপিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

এই হলো খোদ ঢাকা শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। পুলিশ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খুনের কারণ এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি। কিন্তু ঢাকায় হঠাৎ খুন, ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার পেছনে গত ৫ আগস্টের ক্ষমতা বদলের পর যে একের পর এক শীর্ষ সন্ত্রাসী জেল থেকে ছাড়া পেল, তার যোগসূত্র আছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা এতই ঠুনকো যে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমাতে পারছে না। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীতে দিন ও রাত মিলিয়ে এক দিনে পুলিশের ৫০০ থেকে ৫১০টি টহল দল কাজ করছে বলে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে রাতে টহল দল থাকে অন্তত ২৫০টি। টহল দলগুলো ১২০টির (দিন ও রাত) মতো তল্লাশিচৌকি (চেকপোস্ট) পরিচালনা করে।

কিন্তু ওই যে কথায় আছে, কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই, পুলিশের টহল দেওয়ার বিষয়টিও ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবের মিল কম। প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী ১৯ থেকে ২২ জানুয়ারি এবং শুক্রবার রাতে ঢাকার অন্তত ৭০ কিলোমিটার সড়ক সরেজমিনে দেখেছেন যে দু–একটি ব্যতিক্রম স্থান ছাড়া সংশ্লিষ্ট পুলিশ বক্স বা আশপাশের এলাকায় পুলিশের টহল নেই। বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারাও বলেছেন, রাতে ঢাকার সড়কে পুলিশের উপস্থিতি অনেক কম দেখা যায়।

তাহলে ঢাকা শহরের জননিরাপত্তায় সরকারের সর্বাত্মক আয়োজন কি লোকদেখানো? আগস্টের পালাবদলের পর লোকবল কম ও পুলিশ সক্রিয় নয় বলে সরকারের পক্ষ থেকে কারণ দেখানো হয়েছিল। কিন্তু সাড়ে পাঁচ মাস পর তো একই অজুহাত চলতে পারে না। এ সময়ে যদি সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করতে না পারে, কবে করবে? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রধান কারণ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া। এখন পুলিশ বলছে, তারা জামিন বাতিলের জন্য আদালতে আবেদন জানাবে। প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক পালাবদলের সুযোগে তারা কীভাবে কারামুক্ত হলো? বিগত সরকার কি তাদেরও রাজনৈতিক কারণে কারারুদ্ধ করেছিল? যদি সেটা না হয়ে থাকে, তাহলে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যাঁরা কারামুক্ত করেছেন, তাঁদেরও জবাবদিহির মধ্যে আনা দরকার।

স্বার্থান্বেষী মহল সব রাজনৈতিক পালাবদলের সুযোগ নিতে চায়। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ সরকারের উচিত সেই সুযোগের পথ রুদ্ধ করা। সে কাজটি করতে যে তারা এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কথা হলো, সরকারের এই ব্যর্থতা প্রলম্বিত হলে জননিরাপত্তা আরও বেশি হুমকির মুখে পড়বে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরাই ঠিক করুন, সেটি তাঁরা করতে দেবেন কি না।