কক্সবাজার বিমানবন্দরকে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারির মাত্র ১১ দিনের মাথায় সেখান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত মোটেই যৌক্তিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিবেচনা নয়। সমুদ্রতীরবর্তী বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করার জন্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প যে জনগণের জন্য কত বড় বোঝা হতে পারে, তার বিস্তর দৃষ্টান্ত বিগত সরকার স্থাপন করে গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার কেন যাচাই ও প্রস্তুতি ছাড়াই এমন ঘোষণা দেবে, যেখান থেকে তাদের সরে আসতে হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ একদিকে যেমন জাতীয় সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে, অন্যদিকে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ১২ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন প্রথম আলোকে এই সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন। এ বিষয়ে আজ রোববার প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
কারণ হিসেবে জানা যাচ্ছে, বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ঘোষণার পর দেশি–বিদেশি কোনো এয়ারলাইন কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি।
কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালানোকে লাভজনক বলে মনে করছে না সংস্থাগুলো। কেননা অবকাঠামো উন্নয়ন করে একটি বিমানবন্দরকে শুধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলে ঘোষণা দেওয়াটাই শেষ কথা নয়, আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলের জন্য যথেষ্ট যাত্রী ও বাণিজ্যের পরিবেশ আছে কি না, সেটাই সবচেয়ে বড় বিবেচনার বিষয়।
প্রকল্প নেওয়ার আগে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো বিমান পরিচালনা করতে আদৌ আগ্রহী কি না, সেটা যে যাচাই করা হয়নি, সেটাই এখানে প্রতীয়মান হয়। এ ধরনের অটেকসই প্রকল্প নেওয়া ও জনগণের অর্থ অপচয়ের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অবশ্যই জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।
কক্সবাজার ঘিরে বিদেশিদের জন্য পর্যটনশিল্পের বিকাশের সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সব সময়ই একটা উচ্চাশা দেখা যায়। কিন্তু বিদেশি পর্যটক টানার জন্য সমুদ্রসৈকতে যে ধরনের সুযোগ–সুবিধা থাকা দরকার, সেটা কক্সবাজারে নেই।
এ ছাড়া ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে একবারে বড়সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রয় নেওয়ার পর ধারণা দৃঢ় হয় যে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে এনজিও ও দাতা সংস্থার কর্মীদের সরাসরি যাতায়াতের সুবিধা হবে। কিন্তু এটা কতটা বাস্তবসম্মত চিন্তা হতে পারে?
ফলে দেখা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত যাত্রী আছে কি না, সেটা বিবেচনা না করেই কক্সবাজার বিমানবন্দরকে ‘আন্তর্জাতিক মর্যাদা’ দেওয়া হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে অবকাঠামো ও লোকবলের ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। যেমন রানওয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হলেও এর কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি, টার্মিনালগুলোর কাজ যথাযথভাবে শেষ হয়নি, নিরাপত্তাব্যবস্থাও কার্যকর করা হয়নি, যথেষ্ট লোকবলও নিয়োগ দেওয়া হয়নি, কার্গো–সুবিধা ও কার্গো নিরাপত্তাব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। এত সব ঘাটতি থাকলে বিমান সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালানোর ব্যাপারে কতটা আগ্রহী হবে?
প্রধান উপদেষ্টা গত মার্চে কক্সবাজার বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেন। সে সময় বেবিচকের পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে, বাকি কাজ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে। প্রতিদিন বিমানবন্দরটি থেকে ৪০–৫০টি বিমান ওঠানামা করবে। কিন্তু বেবিচকের এই পূর্বানুমানের সঙ্গে বাস্তবতার যে বিস্তর ফারাক, সেটি এখন স্পষ্ট।
প্রকল্প নেওয়ার আগে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো বিমান পরিচালনা করতে আদৌ আগ্রহী কি না, সেটা যে যাচাই করা হয়নি, সেটাই এখানে প্রতীয়মান হয়। এ ধরনের অটেকসই প্রকল্প নেওয়া ও জনগণের অর্থ অপচয়ের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অবশ্যই জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।