প্রাকৃতিক পরিবেশ উজাড় করে ক্রমবর্ধমান মানববসতি, কৃষির জোগান ও কলকারখানা স্থাপনের নিয়মিতই হুমকির মুখে পড়ছে বন্য প্রাণীর বাস্তুসংস্থান। ফলে দেশের নানা অঞ্চলে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে বন্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সংঘাত। এই সংকট মোকাবিলায় শেরপুর বন বিভাগ গ্রহণ করেছে এক মানবিক উদ্যোগ।
প্রথম আলোর খবরে এসেছে, শেরপুরের গারো পাহাড়ে বন বিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে বন্য প্রাণীর জন্য ‘খাদ্যবাগান’ কর্মসূচি। এই উদ্যোগ সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয়। পাহাড়ি বনভূমিতে বন্য হাতিসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর জন্য স্থায়ী খাদ্য ও নিরাপদ আবাসস্থল তৈরির এই প্রয়াস একদিকে যেমন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে তেমনি দীর্ঘদিনের মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব কমানোর বাস্তবসম্মত পথ দেখাবে।
বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তঘেঁষা গারো পাহাড় অঞ্চলে বন উজাড়, অবৈধ দখল ও কৃষি সম্প্রসারণের ফলে বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক আবাসস্থল সংকুচিত হয়েছে। এর সরাসরি ফল হিসেবে খাদ্যের সন্ধানে বন্য হাতির দল প্রায়ই লোকালয়ে নেমে আসছে, ধানখেত ও ফলের বাগান নষ্ট হচ্ছে, ঘটছে প্রাণহানি। এই সংকট মোকাবিলায় কেবল হাতি তাড়ানো বা ক্ষতিপূরণ নয়, বরং হাতির খাদ্য ও আবাসের মূল সমস্যার সমাধানই সবচেয়ে কার্যকর।
রাজাপাহাড়সহ শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ীর টিলাজুড়ে ২৬০ হেক্টর বনভূমিতে ৬২ প্রজাতির ফলদ ও বনজ গাছ রোপণের উদ্যোগ শুধু হাতির জন্য নয়, পুরো বাস্তুতন্ত্রের জন্যই আশীর্বাদস্বরূপ। চাপালিশ, বট, পাকুড়, কাঁঠাল, কলা, আমলকী কিংবা হরীতকীর মতো গাছ পাহাড়ি বনকে আবার প্রাণবন্ত করে তুলবে। এসব গাছ বড় হলে পাখি, ছোট স্তন্যপায়ী ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর খাদ্য ও আশ্রয় নিশ্চিত হবে, যা একটি টেকসই ও স্বাভাবিক বনব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে দেবে।
এই উদ্যোগে স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততাকেও সাধুবাদ জানাতে হয়। পাহাড়ের বাসিন্দারা নিজেরাই বাগান পাহারা দিয়ে দেখিয়েছেন যে বন সংরক্ষণ কেবল প্রশাসনিক প্রয়াসে নয়, টেকসই হয় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে। বন বিভাগ, স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীদের এই সম্পৃক্ততা একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। আমরা আশা করি, খাদ্যবাগানের পরিধি বাড়ানো, দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ এবং অবৈধ দখল ও বন উজাড় রোধ কঠোরভাবে নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি মানুষের জীবিকা ও বন সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য আনতে বিকল্প আয়ের সুযোগও তৈরি করতে হবে।
গারো পাহাড়ের খাদ্যবাগান উদ্যোগ প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা ও সদিচ্ছা থাকলে মানুষ ও বন্য প্রাণীর সহাবস্থান সম্ভব। এই উদ্যোগ শুধু সাধুবাদই নয়, দেশের অন্যখানেও অনুকরণযোগ্য এক মডেল হিসেবেও বিবেচিত হওয়া উচিত।