
‘ক্র্যাক প্লাটুন’ মুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন সত্য আর সুন্দরের পক্ষে। তিনি ছিলেন অকুতোভয়। নিপীড়িত মানবতা বা বিপর্যস্ত পরিবেশ কিংবা অসাম্য প্রতিরোধ বা প্রতিবাদে তিনি ছিলেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো উজ্জীবিত প্রভা।
১৯৭১ সালে স্ত্রী-পুত্র রেখে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যুবকটি দেশ স্বাধীনের পর ফিরে এসে অস্ত্র জমা দিলেও তাঁর ‘চেতনা’র হাতিয়ার হাতছাড়া হতে দেননি। বরং খেলাধুলার অঙ্গনে ব্রাদার্স ইউনিয়ন থেকে ক্রীড়া পরিবারের সভাপতি হিসেবে কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের বিরুদ্ধে সেই ৯০ দশকের শুরুতে সবার সামনে থেকে নতুন যুদ্ধের সূচনা করেন।
জনস্বার্থে মামলা থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের নেতৃত্বে এসে ‘নগর ও নাগরিক আন্দোলনে’র মাধ্যমে প্রতিবাদের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনের আর এক অধ্যায়ে নিজেকে যুক্ত করেন। স্পষ্ট উচ্চারণে নিজের বিশ্বাসের প্রতি সৎ থেকে দৃঢ় সংকল্পে প্রতিবাদের এক অবিচল কণ্ঠস্বরে পরিণত হন এই সম্মুখযোদ্ধা। অনুপ্রাণিত করেন অসংখ্য তারুণ্যে দৃপ্ত মানুষকে। হুমকি, মামলা, কিংবা রোদ-বৃষ্টি-ঝড় অথবা অসুস্থতা, কিছুই তাকে অবদমিত করতে পারেনি।
‘পথ চাওয়াতেই আনন্দ’, রবি ঠাকুরের এই বাণীকে ধারণ করে সারাক্ষণ ছুটে বেড়িয়েছেন। উদ্দীপ্ত করেছেন তরুণদের, তথা বাংলাদেশ স্কাউটস কিংবা গ্রিন ভয়েসের মতো অসংখ্য সংগঠনকে। তারুণে৵র প্রতি এই বিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে তিনি তাদের ‘এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সম্ভাষণ জানাতেন।
স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় বিশ্বাস রেখে, নিজের অর্থে স্বপ্রণোদিত কিংবা জনস্বার্থে আদালতে গিয়েছেন দখলবাজ দুর্বৃত্তায়নের কিংবা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এরূপ উপস্থাপন আর তার মাধ্যমে সংবেদনশীল পরিবর্তনের পাশাপাশি দায়িত্বশীল সমাধানের পক্ষেও জনমত তৈরিতে তাঁর একাগ্রতা, সাধারণ মানুষকে আশাবাদী করার কারণে তাঁকেও জনতার ‘স্পষ্ট প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর’–এ পরিণত করেছিল।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের পাঁচবারের সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি স্থপতিদের এশিয়া অঞ্চলের সম্মিলিত সংগঠন ‘আর্কেশিয়া’ আর কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টসেরও নির্বাচিত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পেশাদারত্বেও প্রশিকা ভবন কিংবা গ্রামীণ ব্যাংক ভবনের মতো অসংখ্য প্রকল্পের অন্যতম রূপকারও ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ও স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় তিনিও বিশ্বাস করতেন যে অতি জনঘনত্বের এই দেশে জনবান্ধব আর প্রকৃতিনির্ভর উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো সামগ্রিক ভৌত অবকাঠামোর পরিকল্পিত বাস্তবায়ন। তাই জ্ঞানভিত্তিক সমাধানের নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশে তার ক্লান্তি ছিল না। কারণ, এ ছিল তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর বিন্যাসের বুনিয়াদি বিশ্বাস।
নাগরিক আর পরিবেশ আন্দোলনের এই পথিকৃৎ মুক্তিযোদ্ধার মহাপ্রয়াণেও তিনি অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, এই প্রার্থনা।
লেখক: স্থপতি ও নগরবিদ