
প্রথম আলো: রাঙামাটিসহ পার্বত্য তিন জেলায় পাহাড় ধ্বসে শতাধিক মানুষ নিহত হলেন। গত প্রায় এক দশক ধরেই পাহাড়ে ধসের ঘটনা এবং প্রাণহানি হচ্ছে। দেড় যুগেরও বেশি আগেও দ্যা চিটাগাং হিল ট্রাক্টস: লাইফ অ্যান্ড নেচার অ্যাটরিকস নামে বই প্রকাশ করেছিলেন। পাহাড়ে প্রকৃতি ও জীবন এখন তাহলে কী আরও বিপর্যয়ের মধ্যে?
ফিলিপ গাইন: একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল জীববৈচিত্র্যের বিপুল আধার। সেখানে পাহাড়ি মানুষের বিচরণ ছিল অবাধ এবং তারা ছিলেন নিরাপদ। কিন্তু গত কয়েক দশকে পাহাড়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় যে নীতি-কৌশল ও কর্মকাণ্ড আমরা দেখি তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এবং সেখানকার পরিবেশও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ ও মানুষ বেশি ঝুঁকির মধ্যে। পাহাড়ি মানুষেরা তাদের ঐতিহ্যগত কৃষি, জ্ঞান, পরিবেশ হারিয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য সবাই এখন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।
প্রথম আলো: সাম্প্রতিক এ দুর্যোগ কী নেহাতই প্রাকৃতিক না এর অন্য কোনো কারণ আছে?
ফিলিপ গাইন: পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে রাঙামাটিতে যেখানে ভারী বর্ষণের পর পাহাড় ধ্বসে গেছে সেখানে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির আগে জনবসতি ছিল না বললেই চলে। কর্ণফুলী উপত্যকা পানির নিচে চলে যাওয়ার পর বর্তমান রাঙামাটি শহর গড়ে ওঠে। এরকম উঁচু জায়গা একটি বড় শহরের জন্য উপযুক্ত ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। আরও অনেক জায়গায় বাঙালি ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। এছাড়া আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাঙালিরা যে ঘরবাড়ী করেছে সেখানেই নিজের পছন্দমত পাহাড় কাটছাট করেছে। পাহাড়ি মানুষ কিন্তু ঘরবাড়ী করে সাধারণত মাচাংয়ের ওপর। তারা পাহাড় কাটে না। পাহাড় কাটছাট করে ঘনবসতি করার ফলে পাহাড় দুর্বল হয়েছে এবং ভারী বর্ষণে ধ্বসে যাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পাহাড় আরো বেশি। কিন্তু সেখানে ভারী বর্ষণে পাহাড় ধ্বসে বিপর্যয় হয়েছে এমন শুনিনি।
তাছাড়া বন ও উদ্ভিদ বিনাশ প্রাকৃতিক এধরনের বিপর্যয়কে আরও ত্বরান্বিত করে বলেই আমার মনে হয়। বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের ঘরবাড়ী নির্মাণ এবং গাছচাষের নানা কর্মকাণ্ডও পাহাড়গুলোকে অনেক দুর্বল করেছে। বিপর্যয়ের জন্য এসব কারণ বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
প্রথম আলো: পাহাড়কে দেখার রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন সময়ের সরকারের মধ্যে কোনো ভিন্নতা দেখেন কী?
ফিলিপ গাইন: ঔপনিবেশিক আমল থেকেই রাষ্ট্র বা সরকার পার্বত্য এলাকাজুড়ে বৃক্ষনিধন ও গাছ চাষ শুরু করেছে। বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন(বিএফআইডিসি) তৈরি হয়েছিল গাছ কাটা বা লগিংয়ের জন্য। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তান আমলে করা হলেও এটির ভূমিকা বদলায়নি। বন ও পাহাড়ের প্রতি এই যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পরিবেশ পরিস্থিতিকে বিপন্ন করেছে। সরকার আসে যায় কিন্তু পাহাড় ও জঙ্গলের ব্যাপারে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয় না। যেকোনো সরকারই পাহাড় ও পাহাড়িদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে গিয়ে সেই এলাকা এবং মানুষের ওপর চরম অন্যায় করেছে।
প্রথম আলো: আঞ্চলিক পরিষদ বা জেলাপরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে না দেওয়ার অভিযোগ পাহাড়ি নেতৃত্ব অনেক আগে থেকেই করে আসছেন। পাহাড়ের প্রকৃতি ও সম্পদের সুরক্ষায় এসব প্রতিষ্ঠানের গুরত্ব কতটুকু?
ফিলিপ গাইন: যেসব প্রতিষ্ঠান পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলে তৈরি হয়েছে এবং যারা মূলত পাহাড়িদের প্রতিনিধিত্ব করে তারা নিঃসন্দেহে পাহাড়ের প্রকৃতি ও সম্পদ রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু শান্তিচুক্তির চেতনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় তারা অসহায়। শান্তিচুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপন চলছে এবং অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে বেশি প্রকৃতিবিনাশ ঘটেছে। তথাকথিত বনায়ন প্রকল্প, রাবার চাষ, তামাক চাষ, পাথর উত্তোলন ইত্যাদির কারণে পাহাড়ের পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত। আঞ্চলিক পরিষদ বা জেলা পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের জন্য নির্ধারিত কাজ সঠিকভাবে করতে পারত তবে পাহাড়ি মানুষের জানমাল খানিকটা সুরক্ষা পেত।
প্রথম আলো: এখন এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে আপনার সুপারিশ কী?
ফিলিপ গাইন: পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি বন, পাহাড়ি মানুষ ও সার্বিকভাবে প্রকৃতির ওপর যে চরম অত্যাচার হয়েছে তা নজীরবিহীন। এসবের সঙ্গে কে কীভাবে জড়িত তাও মোটামুটিভাবে জানা। এমন বিপর্যয়ের মুখে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টমন্ত্রী ও কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে তারা যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে এমন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ও নিরপেক্ষ টাস্কফোর্স গঠন করতে তৎপর হন যার কাজ হবে গভীর অনুসন্ধান এবং অতীতের সব ভুল চিহ্নিত করা এবং পাহাড়, বন ও প্রকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য কার্যকর সুপারিশ প্রণয়ন করা।