
আ ন ম মুনীরুজ্জামান একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট। ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে ভূরাজনীতির নতুন চ্যালেঞ্জ, বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক, রাখাইন ও রোহিঙ্গা সংকট, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের উগ্রবাদী তৎপরতার ঝুঁকি, ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ— এ সব নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে
৫ আগস্ট–পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে ভূরাজনীতির চ্যালেঞ্জগুলো কতটা জটিল হয়েছে বলে মনে করেন? এখানে নতুন চ্যালেঞ্জগুলো কী?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন বেশ কিছু ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে মিয়ানমারের পরিস্থিতি। দেশটিতে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তার প্রভাব আমাদের ওপর পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে রাখাইনের প্রায় ৮০ ভাগ অঞ্চল আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তটা সম্পূর্ণভাবে আরাকান আর্মির দখলে আছে। কাজেই এখানে যে নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিরাজমান, তার বড় ধরনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। এ কারণে খুব গভীরভাবে আমাদের এই অঞ্চলের ওপর নজর রাখতে হবে, যাতে সেখানে যে সংঘাত চলছে, তার স্পিল-ওভার প্রভাব কোনোভাবেই আমাদের ওপর না আসে।
মিয়ানমারের চিন প্রদেশের পরিস্থিতিটাও অস্থিতিশীল। সেখানকার প্রভাব রাখাইনের ওপরও আসছে। বাংলাদেশেও সেই প্রভাব এসে পড়তে পারে। এ ছাড়া মিয়ানমার একটি জটিল আন্তর্জাতিক, ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব রয়েছে রাখাইন অঞ্চলে। তিনটি পরাশক্তির সরাসরি স্বার্থ রাখাইনে জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে চকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে চীন সেখানে অবস্থান করছে। চীন তার জ্বালানির একটা বড় অংশ এই বন্দরের মাধ্যমে নিজেদের দেশে পরিবহন করতে শুরু করেছে। চকচিউ থেকে কুনমিং পর্যন্ত সরাসরি পাইপলাইন রয়েছে চীনের। এ কারণে রাখাইনের সঙ্গে চীনের ভূরাজনৈতিক, ভূজ্বালানি, ভূ–অর্থনৈতিক স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত আছে। চীনে রাখাইনে বেশ কিছু বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করেছে। একই ভাবে রাশিয়াও রাখাইনে অবস্থান নিয়ে ভূ–অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়েছে। রাশিয়াও সেখানে কিছু বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করতে শুরু করেছে।
রাখাইনে ভারতেরও গভীর স্বার্থ রয়েছে, বিশেষ করে কালাদান মাল্টিমোডাল হাইওয়ের মাধ্যমে। সিত্তে থেকে মিজোরাম পর্যন্ত মহাসড়কটির অগ্রগতি হয়েছে। ভারত এখন এ প্রকল্প আরও সম্প্রসারিত করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রও মিয়ানমার ও রাখাইনের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের আইনসভায় বার্মা অ্যাক্ট আইনটি পাস করেছে। এর মাধ্যমে তারা মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সরাসরি সহায়তা দিতে পারবে। সার্বিকভাবে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি ও পরাশক্তির স্বার্থ যেভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে, তার কারণে বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য সব ধরনের প্রভাব আসতে পারে।
এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভারতের সম্পর্কেও অবনতি হয়েছে। এর ভূরাজনৈতিক প্রভাবও বাংলাদেশের ওপর এসে পড়তে পারে। সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান একটা স্বল্পমেয়াদি সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিল। একটা যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে সেটা স্থগিত হয়েছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। ফলে সেখানেও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিটা নাজুক অবস্থায় আছে। সব মিলিয়ে ভূরাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূজ্বালানি পরিস্থিতির কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশও ভূরাজনৈতিকভাবে একটা জটিল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা সর্বাধিনায়ক (সিডিএস) জেনারেল অনিল চৌহান বলেছেন, চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নিজেদের স্বার্থে একে অন্যের প্রতি ঝুঁকছে। এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা দেখেছি যে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ভারতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দিক থেকে এ রকম বক্তব্য ঘুরেফিরে আসছে। গত বছর ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁর দেশের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধপ্রস্তুতি নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেছিলেন। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের এই অবস্থানকে কীভাবে দেখছেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বেশ অবনতি হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাপারে ভারতের একধরনের প্রত্যক্ষ টানাপোড়েন চলছে। ইদানীং আমরা লক্ষ করেছি যে ভারত থেকে তাদের দেশের বেশ কিছুসংখ্যক নাগরিককে বাংলাদেশের ভেতরে পুশ ইন করা হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত কাজ। এ ছাড়া আমরা দেখেছি যে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উক্তি করা হয়েছে, যেটা বাংলাদেশের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সম্প্রতি ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে যে বক্তব্যটি এসেছে, তার মাধ্যমে চীনের কুনমিংয়ে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ত্রিপক্ষীয় বন্দোবস্ত হয়েছে, সেই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
এই ত্রিপক্ষীয় বন্দোবস্তের লক্ষ্য কী, সেটা কিছুটা উল্লেখ করা হলেও বিশদভাবে এ ব্যাপারে এখনো আলোচনা হয়নি। এটা কোন দিকে এগোবে, সেটা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। তা সত্ত্বেও ভারতের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এর কারণ, আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন মেরুকরণের একটা ইঙ্গিত বা লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, যেটা অনেক ক্ষেত্রেই চীনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে যে ধরনের টানাপোড়েন আছে, সেখানে চীন যদি দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি বা কৌশলগত আয়োজন বা বন্দোবস্তের দিকে এগোয়, সেটা ভারত ইতিবাচক হিসেবে দেখবে না।
৫ আগস্টের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে টানাপোড়েন দৃশ্যমান। ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশবিরোধী নানা প্রোপাগান্ডা হয়েছে। দেশটির শীর্ষ নেতারাও বাংলাদেশ নিয়ে নানা সময়ে বিরূপ মন্তব্য করছেন। বাণিজ্য ক্ষেত্রেও ভারত একের পর এক বাধা তৈরি করছে...
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বলা চলে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কটা প্রায় তলানিতে চলে গেছে। বিশেষ করে আমরা দেখছি যে আমাদের বাণিজ্যের ওপর নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক খবর সব সময় প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু সম্পর্কটা উন্নতি করা আমাদের দুই পক্ষেরই প্রয়োজন আছে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তার কারণ, বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই স্বার্থ জড়িত আছে।
ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধরনের নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তার বিপরীতে বাংলাদেশের নিজস্ব বয়ান সঠিকভাবে তাদের কাছে প্রকাশ করা বা উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের ঘাটতি দেখা গেছে। আমাদের নিজস্ব বক্তব্যগুলো তাদের গণমাধ্যম বা অন্যান্য মাধ্যমের মাধ্যমে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারিনি। ভারতে অবস্থিত আমাদের দূতাবাসগুলোকে এ ক্ষেত্রে গতিশীল পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এসব জায়গায় বাংলাদেশের আরও সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে আমরা যদি ভারতের সঙ্গে একটা কার্যকর ও প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে, ভারতকেও এগিয়ে আসতে হবে। দুই দেশের স্বার্থেই এটা করা উচিত বলে আমি মনে করি।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে, আমরা এমন সময়ে এসে পড়েছি, বিশ্ব যেখানে আরও বেশি সংঘাতপ্রবণ হয়ে উঠেছে। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের রেশ কাটতে না কাটতেই ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিল। এই সংঘাতপ্রবণ বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য কতটা ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করছেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বর্তমান বিশ্ব একটি সংযুক্ত পরিস্থিতির ভেতরে সব সময় বসবাস করে। অর্থাৎ পৃথিবীটা খুবই পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত। এ কারণে পৃথিবীর কোনো স্থানে যখনই কোনো সংঘাত হয়, সেটার প্রভাব অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের ওপরও সরাসরি পড়ে। আমরা দেখেছি যে সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়েছে, তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপর পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে যে ধরনের সংঘাতমূলক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেটার সরাসরি বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। এর কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। সেখানে ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কাজ করছেন। আমাদের বিদেশি মুদ্রা আয়ের একটা বড় উৎস মধ্যপ্রাচ্য।
আমরা জ্বালানি আমদানিনির্ভর একটি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় পরিস্থিতি আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলছে। আমরা দেখেছি, তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমরা ইউক্রেন থেকে প্রচুর গম আমদানি করি। সেই বাজারটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। রাশিয়া থেকে আমরা সার আমদানি করি। সেটাও ঝুঁকিপূর্ণ বাজার বলে পরিচিতি পেয়েছে। কাজেই যেকোনো সংঘাত বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করে। এটা আমরা এড়াতে পারি না। কিন্তু প্রভাবটা যাতে সীমিত রাখা যায়, সে ব্যাপারে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।
দুটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি যে সংঘাতের ধরনটা পাল্টে গেছে। ড্রোন, মিসাইল ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এই যুদ্ধ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা প্রথাগত ব্যবস্থাটি কতটা অরক্ষিত, সেটা সামনে আনল। এখানে বাংলাদেশের করণীয়টা কী?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বর্তমান বিশ্বে জাতীয় নিরাপত্তা ও যুদ্ধবিদ্যার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। যে প্রথাগত নিয়মে আমরা এত দিন যুদ্ধবিদ্যা বা জাতীয় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতাম, সেটা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যাচ্ছে। এখানে বিশেষ করে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যুদ্ধটা এখন শুধু সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত হওয়ার বাস্তবতা আর নেই। সম্পূর্ণভাবে প্রযুক্তিনির্ভর একটা যুদ্ধবিদ্যার দিকে চলে যাচ্ছে। যেখানে সৈন্যদের সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়াও প্রযুক্তি দিয়ে নানা ধরনের যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ড্রোনের ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপক আকারে। এ ছাড়া মিসাইল ব্যবহার হচ্ছে এবং দূরপাল্লার মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়া আমরা দেখছি যে আধুনিক গোলন্দাজ যে প্রযুক্তিগুলোও ব্যাপক হারে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দিকেই জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা ঝুঁকে যাচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়া কোনো দেশ হয়তো ভবিষ্যতে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা আর নিশ্চিত করতে পারবে না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শুধু ভৌগোলিক যে সীমান্তগুলো আছে, সেগুলোর সুরক্ষা দেওয়াটাই জাতীয় প্রতিরক্ষার প্রধান লক্ষ্য আর থাকছে না। আমরা দেখছি, একটি জাতিকে পরাস্ত করার জন্য অর্থনৈতিক যুদ্ধ হচ্ছে, তথ্যভিত্তিক যুদ্ধ হচ্ছে। নানা ধরনের অপ্রচলিত যুদ্ধে একদেশ অন্য দেশের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখছি যে যুদ্ধতে পৌঁছানো ছাড়াও গ্রে জোন ওয়ারফেয়ারের মাধ্যমে এক দেশ আরেক দেশকে পরাস্ত করছে।
কাজেই এই সমরাস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যা, জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা কীভাবে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে, সে ব্যাপারে জাতীয়ভাবে বিশদ আলাপ-আলোচনা করে এখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে আবার নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার।
জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আপনি এর আগে জাতীয় নিরাপত্তা সমন্বয় সংস্থা গঠনের কথা বলেছিলেন। বর্তমান বাস্তবতায় সেটা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে কি?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তার কারণ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিমালার ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে নীতিমালাগুলো প্রণয়ন করা হয়নি। যেকোনো দেশের জন্য এই নীতিমালাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কিটেকচার বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। সে কারণে আমাদের সক্ষমতাগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বয়ের কাজটি অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটির সঙ্গে শুধু সশস্ত্র বাহিনী জড়িত থাকে না। বর্তমান বিশ্বে এ জায়গায় সমগ্র সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা থাকে। সে জন্য রাষ্ট্রীয় সব ধরনের সক্ষমতা একই ছাতার নিচে সমন্বয় করার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, সেটা খুব শিগগির আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এ জায়গায় এখন পর্যন্ত অনেক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য একক কোনো বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়া কতটা বাস্তবসম্মত হবে? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থানটা কী হওয়া উচিত?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বাংলাদেশ একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অবস্থানে অবস্থান করে। বিশেষ করে আমরা বঙ্গোপসাগরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত দেশ। বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরীয় দেশও। এ কারণে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে এবং উঁচু স্থানে চলে গেছে। বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রণয়ন করা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কারণে ভারত মহাসাগর কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
চীনের প্রণীত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেও (বিআরআই) দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন করিডরের মাধ্যমে তারা অনেক ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। কাজেই দুটি পরাশক্তিরই একই মহাসাগরের ওপর যে কড়া দৃষ্টি বা স্বার্থ জড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে আমাদের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিটা একটু স্পর্শকাতর হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটা হচ্ছে, আমরা যাতে সব ক্ষেত্রে একটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখি।
আমরা যাতে কোনো একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে বা কোনো চুক্তির সঙ্গে এককভাবে জড়িয়ে না পড়ি। আমাদের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে আমরা সবার সঙ্গে কাজ করতে চাই এবং একইভাবে আমাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চাই। আমরা এককভাবে কারও সঙ্গে সংযুক্ত হলে আমরা অন্য পক্ষের নেতিবাচক দৃষ্টিতে চলে আসতে পারি। সেখানে আমাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে। কাজেই আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ পথ হবে কৌশলগত নিরপেক্ষতা ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা বজায় রাখা।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে ভারসাম্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ঝুঁকে পড়েছে। রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই আরাকান আর্মির হাতে। রোহিঙ্গাদের কারণে আরাকানের সঙ্গে আমাদের বড় স্বার্থ রয়েছে। রাজ্যটিতে চীন ও ভারতের স্বার্থটাও বড়। আবার মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট পাস করেছে। সব মিলিয়ে মিয়ানমার ও রাখাইন ঘিরে একটা জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বিরাজ করছে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে? বাংলাদেশের সামনে পথটাই–বা কী?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আমাদের দুটি পথে এগোতে হবে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে, তাদের আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। আবার আমাদের প্রতিবেশী রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে চলে গেছে। তবে আরাকান আর্মি কোনো রাষ্ট্রীয় সত্তা নয়, তারা একটি অরাষ্ট্রীয় সত্তা। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা তাদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলোচনা করতে পারি না। তবে অন্যান্য চ্যানেলে আরাকান আর্মির সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনের একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে কূটনীতির চেয়ে কৌশলগত মারপ্যাঁচ কাজে লাগাতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্মুখপথে আমাদের কূটনীতি পরিচালিত হবে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাক চ্যানেলে কূটনীতি পরিচালিত করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে তাদের দক্ষতা প্রমাণের এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের কার্যকর একটা সম্পর্ক বজায় রেখে এগোতে হবে। তবে কোনোভাবেই এমন কিছু করা যাবে না, যেটা মিয়ানমার সরকারের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীতে চলে যায়।
রাখাইন পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সংকটে নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। নতুন করে রোহিঙ্গা এসেছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমেছে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ জন্মভূমিতে ফেরানোর বিষয়টা কতটা জটিল হলো?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: পরিস্থিতিটা জটিল হয়ে উঠছে আরও বেশি কারণে যে রোহিঙ্গারা মানবিক যে একটা পরিস্থিতির ভেতরে ছিল, সেটা থেকে এটা উত্তরণ করে এটা একটা নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় রূপান্তরিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতরে অনেকে বিভিন্ন ধরনের বেআইনি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। যেমন তাদের অনেকে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। এখান থেকে বিভিন্ন দেশে মানব পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র আসছে, সেগুলো বিভিন্ন দেশে চোরাচালান হচ্ছে। কাজেই এটা শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে না; বরং বলা চলে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর একটা বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে।
এ ছাড়া এই অঞ্চলে যে ধরনের উগ্র মতবাদের সৃষ্টি হচ্ছে, সেটার প্রভাবও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পড়তে শুরু করেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন যেমন আরসা বা আরএসও ইতিমধ্যে রাখাইনের ভেতরে গিয়ে বিভিন্ন সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এখন রাখাইনের ওপর আরাকান আর্মির যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ আছে, তাতে তাদের সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই তাদের জন্মভূমিতে ফেরত যেতে পারবে না।
আরসা, আরএসওর মতো সংগঠনগুলোর তৎপরতার কারণে আরাকান আর্মির রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে খুবই নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে। এখন আমরা যদি ধরেও নিই মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে রাজি হয়, কিন্তু দেখা যাবে যে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের রাস্তাগুলো খুলে দেবে না। কাজেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ভবিষ্যৎটা খুবই অনিশ্চিত।
অদূর ভবিষ্যতে তারা সেখানে ফেরত যাবে বলে মনে করি না। কাজেই এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আমরা কীভাবে এখানে রাখব, সেটা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। কেননা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা উদ্বেগজনকভাবে কমে যাচ্ছে। প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা এখানে আগে থেকেই বাস করছিল। গত ১৮ মাসে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে এসেছে। প্রতিবছর রোহিঙ্গা শিবিরে ৪০-৫০ হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে। কাজেই রোহিঙ্গা সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কয়েকজন তরুণের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। বৈশ্বিক ও আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে এ ঘটনা আমাদের জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি করল?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: মালয়েশিয়ায় উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে আমাদের তরুণদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আমাদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। আমাদের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে আসছে। মালয়েশিয়া আমাদের বড় শ্রমবাজার। মালয়েশিয়ায় উগ্রবাদী তরুণেরা যে সমস্যাটা সৃষ্টি করেছে, সেটা শুধু মালয়েশিয়ার ভেতরে সীমিত নয়। তারা সেখান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মধ্যপ্রাচ্যে আইএসআইএসের কাছে পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিল। কাজেই এখানে একটা আন্তর্জাতিক মাত্রাও যোগ হয়েছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশেও এ ধরনের উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগ থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। কাজেই শুধু মালয়েশিয়ায় একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, এভাবে দেখা ঠিক হবে না। বাংলাদেশে তারা কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে কিংবা কাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে, সেটা আমাদের খুব গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।
আমাদের আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিটা একেবারে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশ সঠিকভাবে কাজ করছে না। উগ্র মতবাদ ও জঙ্গি মতবাদ দমনের জন্য পুলিশের বেশ কিছু বিশেষায়িত ইউনিট তৈরি করা হয়েছিল। সেই ইউনিটগুলো বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে। এসব ইউনিটের যে সক্ষমতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেটা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে নজর দেওয়া ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের সক্ষমতাটা একেবারে নেই বললেই চলে। কাজেই উগ্রবাদের কারণে আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো কিন্তু আমরা সঠিকভাবে যাচাই করতে পারছি না। এদিকে আমাদের খুব দ্রুত দৃষ্টি দিতে হবে।
মালয়েশিয়ায় যারা জেলে আছে বা যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে, আমরা যদি খুব বলিষ্ঠ এবং পরিষ্কার ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নিই, তাহলে মালয়েশিয়া নয়, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য অনেক দেশে আমাদের শ্রমবাজারের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খুবই আশু কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম চোখে পড়েনি। যে গুরুত্ব দিয়ে এই সমস্যাটা তাদের সামাল দেওয়া উচিত ছিল, সেটা তারা করেনি। এই দুর্বলতার সমস্যাটাকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।
প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করে শুল্ক কমাতে পারলেও বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণ কী বলে মনে করেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ–অর্থনৈতিক সমস্যাট। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল। পরে আলাপ-আলোচনার জন্য তারা এই সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছিল। সে ক্ষেত্রে এই সময়কে কাজে লাগিয়ে অনেক দেশ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যেমন ভিয়েতনাম আলোচনার মাধ্যমে তাদের ওপর আরোপিত শুল্ক ২০ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমরা জানতে পারছি, ভারতও প্রায় ২০ শতাংশ বা তার নিচে শুল্ক নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কার্যকর আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা সময়টাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির চেষ্টা সঠিক ব্যক্তির দ্বারা করা হয়নি। যেমন ওয়াশিংটনে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা উপস্থিত থেকে আলোচনাটা পরিচালনা করছিলেন। এটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ। এটি কোনোভাবেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাজ নয়।
এখানে আরেকটি বড় ঘাটতির জায়গা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাঁরা রপ্তানি করেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ত করাও হয়নি। কাজেই যে আলাপ-আলোচনাটি হয়েছে, সেটা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, সেটা আমরা জানি না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে চিঠিটা দিয়েছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে পূর্বঘোষিত ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে শুল্ক ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। এখন আমাদের যদি ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হয়, আর আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো যদি আমাদের চেয়ে কম শুল্ক দেয়, তাহলে কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে আমরা অনেকখানি পিছিয়ে পড়ব। এতে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পে যে চাপ তৈরি হবে, তাতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। সেই বাজারে রপ্তানি যদি বিঘ্নিত হয়, তার স্পিল-ওভার প্রভাব ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারসহ অন্যখানেও পড়বে। আমরা এরই মধ্যে শুনতে পাচ্ছি, ইউরোপের কিছু কিছু ক্রেতা বলতে শুরু করেছেন, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে দর-কষাকষি করতে চান। এটা আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। কেননা আমরা রপ্তানির ক্ষেত্রে এককভাবে তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ৩৫ শতাংশ শুল্কের কারণে অর্থনীতির ওপর যে ঝুঁকি আসবে, সেটা মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন হবে।
এ রকম ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে যে দর-কষাকষির বিষয়টাকে যে ধরনের গুরুত্ব দেওয়া দরকার, যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল, সেটা করা হয়নি। এখানে উচিত ছিল ট্রেড লবিস্ট নিয়োগ করা। ভিয়েতনামসহ আরও কিছু দেশ খুবই দক্ষ ট্রেড লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। বাংলাদেশ সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রথমে দায়সারাভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে, শেষ মুহূর্তে নেগোসিয়েশন করতে গেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তো নেগোসিয়েশন হয় না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অপর পক্ষ যখন জানে যে আমরা খুব নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছি, তারা তো আমাদের কাছ থেকে যতটুকু পারে, ততটুকু নেওয়ার চেষ্টা করবেই।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।