শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক। ড্যাপ প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের পর সেখান থেকে রাজউকের সরে আসা এবং এর কী প্রভাব নগরজীবনে পড়তে যাচ্ছে, তা নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ সাবিহা আলম

প্রথম আলো: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে এ নিয়ে দুবার ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ হলো এবং সমালোচনার মুখে ড্যাপকে টেকানো গেল না। ড্যাপেই কি সমস্যা? আগে কখনো রাজধানী নিয়ে পরিকল্পনা হয়েছিল?
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: পরিকল্পনা আগেও হয়েছিল। রাজধানী হিসেবে ঢাকার বয়স ৪০০ বছর পেরিয়েছে, মতান্তরে ঢাকার বয়স আরও বেশি। সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি ও স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকাকে নিয়ে পরিকল্পনা হয়েছে। তবে তিন আমলে তিন রকম। ঔপনিবেশিক আমলে এটা ছিল জেলা শহর, পাকিস্তান আমলে প্রাদেশিক রাজধানী এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। ঢাকাকে নিয়ে প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন স্যার প্যাট্রিক গেডেস, ১৯১৭ সালে। তখন ঢাকার জনসংখ্যা কম ছিল, বুড়িগঙ্গা নদীও ছিল দূষণমুক্ত, শহর ছিল সবুজ। মোটের ওপর ঢাকা ছিল বাসযোগ্য। ভারত ভাগ হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তান সবকিছু নিয়ে প্রতিযোগিতা করেছে। ভারত চণ্ডীগড়সহ বেশ কিছু শহরে পরিকল্পিত নগরায়ণ করে। এর জবাবে পাকিস্তানও করাচিসহ কয়েকটি শহরে পরিকল্পিত নগরায়ণ শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে তারা ঢাকাকে বেছে নিয়েছিল। সেই লক্ষ্যেই ১৯৫৩ সালে প্রণীত দ্য টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টের আওতায় ১৯৫৬ সালে ডিআইটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৫৯ সালে ঢাকার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭১-এ ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হয়। শহরটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বও সে সময় বাড়ে। সে হিসাবে পাকিস্তান আমলে নেওয়া পরিকল্পনা তার কার্যকারিতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। স্বাধীন বাংলাদেশে অগ্রাধিকারেও পরিবর্তন আসে।
প্রথম আলো: তার মানে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংকটের চাপে আমরা ঢাকাকে ভুলে গেলাম...
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: ভুলে গেলাম বলাটা ঠিক হবে না। ধরুন স্বাধীনতার আগে আমরা ঢাকামুখী জনস্রোত সেভাবে দেখিনি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেশের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠায় মানুষ স্বাধীনতার পর ঢাকায় আসতে শুরু করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর পুনর্গঠনসহ সরকারের সামনে তখন অনেক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু একটু গুছিয়ে উঠেই তারা পরিকল্পনায় নজর দেয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হয় ১৯৭৩ সালে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। ওই পরিকল্পনাতেই সারা দেশে নগরায়ণের চেহারা কেমন হবে, তার একটা পরিষ্কার নির্দেশনা ছিল। আমরা জানি, ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নগর-পরিকল্পনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কোর্স খোলা হয়। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য দক্ষ জনবল তৈরিতে করতে বুয়েট ও শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির মধ্যে চুক্তি হয়। আমরা সবাই কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর কথা জানি। তিনি কিন্তু এই প্রোগ্রামের আওতাতেই শেফিল্ডে গিয়েছিলেন।
প্রথম আলো: ওই পরিকল্পনার কোনো প্রভাব কি আমরা এই ঢাকায় আর দেখতে পাই? বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থা তো তলানিতে...
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর একটা স্থবিরতা আসে। কিন্তু নগরায়ণের দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনো বিবেচনায় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ছিল সেরা। পরে বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এখন চলছে। তবে গুণগত দিক থেকে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ধারেকাছেও কোনোটা পৌঁছাতে পারেনি। ধরুন কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন, তাঁকে পরিকল্পনা শিখতে পাঠানো হয়েছিল। এই তালিকায় স্থাপত্য,অর্থনীতি, ভূগোলসহ একটা নগরকে ভালো রাখতে যে যে খাতের বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হয়, সে সে খাতের ছাত্রদের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। কথা ছিল তাঁরা ফিরে এসে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের নগর ও গ্রামীণ জনপদে গড়ে তুলতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন। কিন্তু ’৭৫-পরবর্তী যে সরকারগুলো এসেছে, তারা বলার চেষ্টা করেছে ওই পরিকল্পনা সমাজতান্ত্রিক, তাই ওটাকে বাদ দিতে হবে। ফলে ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। আমি বলব বিশৃঙ্খলার শুরু তখন। এরপর নগর-পরিকল্পনায় একটা ছেদ পড়ে। ’৮০ সালে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। এর প্রায় ১৫ বছর পর ১৯৯৫ সালে মহাপরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই পরিকল্পনার নাম ছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান।
প্রথম আলো: এই মহাপরিকল্পনাকেই কি আমরা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ বলছি? পরিকল্পনা নিয়ে লাভ হলো কিছু? ড্যাপ নিয়ে ঢাকাবাসীর খুব পরিষ্কার ধারণা কি আছে? ঢাকা তো দিনকে দিন কেবল খারাপই হচ্ছে...
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: ড্যাপ ছিল এই মহাপরিকল্পনার সর্বশেষ ধাপ। এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) সহযোগিতা করেছিল। এর আওতায় স্ট্রাকচার প্ল্যান, আরবান এরিয়া প্ল্যান ও ড্যাপ হয়। ড্যাপ চূড়ান্ত হয় ২০১০ সালে এসে। এই প্রথম আমরা একটা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা পাই। এখন আসি ড্যাপটা কী, সেই আলোচনায়। ড্যাপের আয়োজক হলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক। রাজউককে এই কাজে সহযোগিতা করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তারা যে প্রতিবেদন জমা দেয়, সেটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটি কারিগরি ব্যবস্থাপনা কমিটি। এই কমিটিতে নগর–পরিকল্পনাবিদসহ অংশীজনেরা ছিলেন। রাজউকের পক্ষ থেকে তাঁরা প্রতিবেদনটি পরিবর্তন, পরিমার্জন করে সুপারিশমালা চূড়ান্ত করেন। রাজউক ড্যাপের খসড়া জমা দেয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে যায়। সেখানে ভেটিংয়ের পর গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
প্রথম আলো: আমরা পরপর দুটি ড্যাপই গেজেট হওয়ার পর বাতিল হতে দেখলাম। নতুন ড্যাপ চাপানো হলো। সেটা কেন? তাহলে এই ড্যাপের মূল্য কী?
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: এটা আসলে দুঃখজনক। তার মানে গেজেট কি শুধু একটা কাগজ? প্রথম ড্যাপ অনুমোদনের পর গেজেট হলো। তৎকালীন পূর্ত প্রতিমন্ত্রীকে একজন আবাসন ব্যবসায়ী ধমকাচ্ছেন, এমন ভিডিও এখনো সার্চ দিলে আপনি পাবেন। কারণ হলো, ড্যাপে ফ্লাড ফ্লো অঞ্চল বা বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলগুলো সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিল। আবাসন ব্যবসায়ীরা এর ঘোর বিরোধিতা করেন। কারণ, তাঁরা এই অঞ্চলের জমি কিনে মাটি ফেলে ভরাট করে দেদার বিক্রি করছিলেন। তাঁদের চাপে পড়ে ২০১০ সালে গেজেট হওয়ার পর আবারও সরকার একটা রিভিউ কমিটি করে দিয়েছিল। আমরা দেখলাম, আবাসন ব্যবসায়ীদের অনেক দাবিই ওই সময়ে মেনে নেওয়া হয়েছিল। তারপরও ওই ড্যাপে ভালো কিছু বিষয় ছিল। তারও সিংহভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
প্রথম আলো: ড্যাপে ভালো কিছু বিষয় কী কী ছিল বা আছে?
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: ড্যাপ মানে তো শুধু ভবন নির্মাণ নয়। যদি সর্বশেষ ড্যাপের কথা বলি, এখানে অনেকগুলো বিষয় আছে, যেমন ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলকে জনঘনত্ব অনুযায়ী ভাগ করা, ব্লকভিত্তিক আবাসন, নগরবাসীর জীবনযাপন, গণপরিবহন, পথচারী ও অযান্ত্রিক যান চলাচল, ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য সুলভ ও সাশ্রয়ী আবাসন, বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চলের ধারণা, স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তাব ও বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক। মোটের ওপর ঢাকা শহরে খেয়ে–পরে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে যা যা দরকার, ড্যাপে তার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে।
প্রথম আলো: আপনি বলছিলেন ২০১০ সালে অনেক কাটাছেঁড়ার পর আমরা যে ড্যাপ পেলাম, সেটার খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যেই আমরা ২০১৬-৩৫ মেয়াদি আরেকটা ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু করলাম। তো, আগের ড্যাপ বাস্তবায়িত হলো না কেন?
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: আসলে ড্যাপের বাস্তবায়ন নিয়ে কর্তৃপক্ষেরও স্বচ্ছ ধারণার অভাব আছে বলে মনে হয়। ধরুন ড্যাপ যখন গেজেট হবে, তখন তা শুধু রাজউক কিংবা আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নয়, অন্যদের জন্যও বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা। সেটা কখনোই হয়নি। শহরের মধ্যে তো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ওয়াসা করছে, ডেসকো, ডিপিডিসি, সেতু বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক বিভাগসহ আরও অনেকে। তাঁরা যখন কোনো অবকাঠামো করছেন, তখন ড্যাপকে আমলে নিচ্ছেন না। উদাহরণ হিসেবে হাতিরঝিলের কথা বলা যায়। এত অর্থ ব্যয়ে হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এখন সেতু বিভাগের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কিছু অংশ ভরাট করে খুঁটি পোঁতা হচ্ছে। অথচ ড্যাপ মাথায় থাকলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শুরুতেই হাতিরঝিল যেন ভরাট করতে না হয়, সে অনুযায়ী এগোত বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। সেটা হয়নি।
প্রথম আলো: এবার ড্যাপ নিয়ে আপত্তি কারা দিল, কেন?
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ড্যাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যে সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ফ্লোর এরিয়া রেশিও (সংক্ষেপে ফার/অঞ্চলভেদে ভবনের উচ্চতা, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ কী হবে) ও জনঘনত্ব জোনিংয়ের বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ও বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ) আবেদন করেছিল। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে নতুন করে গেজেট প্রকাশ করতে হলো। তারা প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য রাজউক একটি কমিটি গঠন করে এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের কাছে তারা দুজন সদস্যও চেয়ে পাঠিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজউক আর কারও সঙ্গে কথা বলেনি। নিজেরা নিজেরা সংশোধন করে ড্যাপে পরিবর্তন এনেছে। এমন পরিবর্তনে জনভোগান্তি আরও বাড়বে। এর ফলে বড় ধরনের একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি হলো বলে আমি মনে করি।
প্রথম আলো: রিহ্যাব ও বিএলডিএর আপত্তির জায়গাটা কোথায়?
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: তাদের আপত্তির মূল জায়গাটা হলো ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার)। ড্যাপে প্রস্তাব করা হয়েছিল, জনঘনত্ব ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এলাকাভেদে ফার দেওয়া হবে। ধরেন ঢাকা শহরের বেশ কিছু জায়গা অপেক্ষাকৃত কম উন্নত, সেখানে নাগরিক সেবা অপ্রতুল এবং জনঘনত্ব বেশি। এসব জায়গায় ফার কম দেওয়ার সুপারিশ করেছিল ড্যাপ প্রণয়ন কমিটি। ওতেই আপত্তি জানিয়েছে কোনো কোনো পক্ষ।
প্রথম আলো: এমন একটা আলোচনা আছে যে ড্যাপ প্রণয়ন কমিটি নগরের ধনী এলাকাগুলোয় ফার বেশি দিয়ে দরিদ্র এলাকায় ফার কম দিয়েছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই দরিদ্র এলাকাগুলোকে ফার কম দেওয়া হয়েছে, তাদের জন্য প্রণোদনার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল কি না?
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: দেখুন, যে জায়গায় রাস্তা খুবই সংকীর্ণ, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো নয়, খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত অঞ্চল নেই, কাছেপিঠে স্কুল বা হাসপাতাল নেই, সে জায়গায় যদি সুউচ্চ ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আরও বেশি মানুষ সেখানে বসবাস করবেন এবং বিদ্যমান যে অবকাঠামো, তার ওপর আরও বেশি চাপ পড়বে। আপনি থাকবেন বাসাবোতে কিন্তু চিকিৎসার জন্য যেতে হবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তাহলে তো সামগ্রিক ট্রাফিকের ওপর একটা চাপ তৈরি হবেই। তা ছাড়া ড্যাপে কিন্তু যেখানে ভূমিমালিকেরা ফার কম পাচ্ছেন, তাঁদের জন্য কিছু সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল। এটাকে বলা হয়েছে ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস বা উন্নয়নস্বত্ব বিনিময় পদ্ধতি। ধরুন কারও বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলে জমি আছে, আবার অন্যত্রও জমি আছে। তিনি বন্যাপ্রবণ এলাকায় চারতলা বাড়ি করতে পারতেন। কিন্তু ড্যাপ অনুসরণ করে বানালেন না। তার বিনিময়ে তাঁর অন্য যে জায়গায় জমি আছে, সেখানে তিনি বন্যাপ্রবণ এলাকায় যে কটি ইউনিট ছেড়েছেন, সমপরিমাণ ইউনিট বা ফ্লোর পাবেন। কিন্তু ফারের বিপক্ষে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটা প্রচারণা চালানো হয়। রাজউক এতে প্রভাবিত হয়ে হুট করে অনুমোদিত ড্যাপ পরিবর্তন করে ফেলল। রিহ্যাব ও বিএলডিএ প্রতিষ্ঠিত করে ফেলল যে বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে যে প্রস্তাবই তৈরি করা হোক না কেন, ব্যবসায়িক স্বার্থে তা পরিবর্তন করার সক্ষমতা তাদের রয়েছে।
প্রথম আলো: রাজউক কী বলছে? নগর-পরিকল্পনায় রাজউকের খুব বলিষ্ঠ ভূমিকা দেখেন? রাজউককে নগরবাসী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং অনিয়মের কারখানা হিসেবে চেনে...
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: এবারের ড্যাপে রাজউকের নগরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। ড্যাপে ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতির প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। এতে করে রাজউক ও নগরবাসী—দুই পক্ষই উপকৃত হতে পারত।
প্রথম আলো: ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতিটা কেমন?
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: এই আবাসনপদ্ধতিতে ছোট ছোট প্লটের মালিকদের একত্র করে ভবন তৈরির কথা বলা হয়েছে ড্যাপে। ধরুন তিন কাঠার প্লট আছে চারজনের, তাঁরা যদি আলাদা বাড়ি বানান, তাহলে কোনো বাড়িতে আলো-বাতাস ঢুকবে না, বাড়িতে তাঁদের ঢোকা ও বেরোনোর পথও হবে চিপা চিপা। কিন্তু যদি ১২ কাঠার ওপর একটা বহুতল ভবন হয়, তাহলে তাঁরা আরামে থাকতে পারবেন। থাইল্যান্ডে এই ব্যবস্থা খুব সফল হয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসনের জন্য সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছিল। এই ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হয় সরকারের সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি সমবায় সমিতি সম্পৃক্ততার মাধ্যমে। এই সমিতিতে নিয়মিত নির্বাচন হয়, নির্বাচিত প্রতিনিধি ভবনের
নকশা প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত নেতৃত্ব দেয়। ওই ফ্ল্যাট বা ভবন থেকে কেউ বেরিয়ে যেতে চাইলে সমিতির কাছেই বিক্রি করে যেতে হয়। আমাদের দেশেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন নিশ্চিতের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে, ফ্ল্যাট ধনী লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়ে বস্তির মানুষ বস্তিতে ফিরে গেছেন। রাজউক ঢাকা শহরের সব মহল্লায় এ ধরনের দিশারি প্রকল্প নিতে পারে। এতে তাদের ভাবমূর্তিরও উন্নতি হয়। আর সাধারণ মানুষ একবার উপকৃত হলে তারাও চাইবে এ ধরনের আবাসন ব্যবস্থায় যেতে।
প্রথম আলো: প্রতিবারই ড্যাপ প্রণয়নের পর এতে পরিবর্তন আসছে এবং জনভোগান্তি বাড়ছে। এখন উপায় কী?
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: ড্যাপের গেজেট শুধু একটা কাগজ হয়ে যেন না থাকে, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। রাজউকের নেতৃত্বে লম্বা সময় ধরে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের পর ড্যাপ হচ্ছে, সেটির বদল হচ্ছে এবং বদলের পরও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এতে আসলে নগরবাসীর কোনো উপকারই হচ্ছে না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বোঝাতে হবে যে ড্যাপ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। যে যেই কাজই করুক না কেন, ড্যাপের যেন ব্যত্যয় না হয়। এ-ই হলো প্রথম কথা। আর দ্বিতীয় কথা হলো, যেভাবে ড্যাপটা কাটাছেঁড়া হলো তাতে ঢাকা শহরের বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য দুই-ই বাড়বে। এটা সুনিশ্চিত।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
শেখ মুহম্মদ মেহেদী হাসান: আপনাকেও ধন্যবাদ।