মাইকেল এস স্টেকলা
মাইকেল এস স্টেকলা

বিশেষ সাক্ষাৎকার: মাইকেল এস স্টেকলার

ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমায়, তা ঠিক নয়

মাইকেল এস স্টেকলার একজন ভূ-পদার্থবিদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেমন্ট–ডোহার্টি আর্থ অবজারভেটরির অধ্যাপক। তিনি মূলত পললগঠিত মাটির নিয়ে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং মিয়ানমারের কিছু অংশে ২০ বছর ধরে কাজ করছেন এবং অসংখ্য মাঠ গবেষণায় অংশ নিয়েছেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর কাজের প্রধান ক্ষেত্র হলো বাংলাদেশ। তাঁর গবেষণা প্রকল্পগুলো টেকটোনিক ও ভূমিকম্পের পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং স্তরবিন্যাস সম্পর্কিত। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ই-মেইলে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রশ্ন

আপনি এবং আপনার সহকর্মীরা ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ভূগর্ভের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। ঢাকার আশপাশে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের এই ধারা দীর্ঘমেয়াদি জিপিএস পর্যবেক্ষণের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর আপনাদের এই পর্যবেক্ষণ এই অঞ্চলের চলমান ভূমিকম্প সম্পর্কে কী জানাচ্ছে?

মাইকেল স্টেকলার: জিপিএস পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এখানে ফোল্ডবেল্টে (এটি এমন একটি ভৌত গঠন, যেখানে পৃথিবীর ভূত্বক টেকটোনিক শক্তির কারণে ভাঁজ বা বাঁক নিয়ে তৈরি হয় এবং সাধারণত অনেক ঘন পলি দিয়ে গঠিত) প্রতিবছরে ১১ থেকে ১২ মিলিমিটার হারে সংকোচন ঘটছে।

এটি একধরনের চাপ তৈরি করছে এবং সম্ভাব্য ভূমিকম্পের একটি ইঙ্গিত দিচ্ছে। সম্প্রতি আমরা এমন কিছু গতিবিধি লক্ষ করেছি, যেখানে হয়তো পাহাড়ি গঠনগুলোতে কিছু ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। যাতে মনে হয়, সামান্য হলেও বিপদের মাত্রা কমাতে পারে। তবে এটা পুরোপুরি ঠিক, তা না-ও হতে পারে।

ফোল্ডবেল্টের নিচে ভারতীয় প্লেটটি সাবডাকশন (দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল) বা নিম্নগামী হচ্ছে। ওপরের ইন্দো–বার্মা ফোল্ডবেল্ট এবং নিচের ভারতীয় প্লেটের মধ্যবর্তী সীমারেখাই মেগাথ্রাস্ট (মেগাথ্রাস্ট হলো পৃথিবীর বড় প্লেটগুলো একে অপরের নিচে চাপ দেওয়ার কারণে তৈরি হওয়া বড় ভূমিকম্প-সৃষ্ট ফল্ট বা চ্যুতি)।

এটি সেই ভাঙনরেখা, যা বড় ভূমিকম্পের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। আমরা ২০১৬ সালের আমাদের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে প্রকাশিত ফলোআপ পেপারে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের মাত্রা ৮ থেকে ৮ দশমিক ২ পর্যন্ত পুনর্নির্ধারণ করেছি। এ ছাড়া নিচের প্লেট যখন নিম্নগামী হচ্ছে, তখন তাতেও ভূমিকম্প ঘটতে পারে। আমরা মনে করি সাম্প্রতিক ভূমিকম্পটি নিচের প্লেটে হয়েছে এবং মেগাথ্রাস্ট থেকে আসা ঝুঁকিকে প্রভাবিত না-ও করতে পারে।

প্রশ্ন

সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে বাংলাদেশের তলার মাটি প্রতিবছর প্রায় দুই ইঞ্চি উত্তর-পূর্ব দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এই গতিবিধি ঢাকার আশপাশে চাপ জমার সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত এবং এটি কি সাম্প্রতিক ভূকম্পনের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পর্কিত?

মাইকেল স্টেকলার: হ্যাঁ, বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৫ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার হারে উত্তর-পূর্ব দিকে সরছে। ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয় মূলত প্লেটগুলোর আপেক্ষিক গতির কারণে। সমস্যাটি শুধু এটি নয় যে বাংলাদেশ বা ভারত উত্তর-পূর্ব দিকে চলছে, বরং এশিয়া আলাদা দিক থেকে ভারতের দিকে সরছে, যার ফলে উত্তরে হিমালয় ও শিলং এবং পূর্বে ইন্দো–বার্মা সাবডাকশন জোনের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রশ্ন

সাম্প্রতিক ছোটখাটো ভূমিকম্পগুলো কীভাবে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা বোঝার ক্ষেত্রে আপনার ধারণাকে প্রভাবিত করছে?

মাইকেল স্টেকলার: দেখুন, এখানে দুটো বিষয় আছে। প্রথমটি হলো, আমরা মনে করি এই ভূমিকম্পটি মেগাথ্রাস্টের ওপর বা এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। তাই এটি বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করছে না।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ভূমিকম্পের মাত্রার স্কেল লগারিদমিক। (ভূমিকম্পের মাত্রা লগারিদমিক স্কেলে মাপা হয়। লগারিদমিক বলতে বোঝায় এমন একটি স্কেল বা মান, যেখানে সরল যোগফলের পরিবর্তে পরিমাণ বা মান বৃদ্ধি পায় গুণিতক হিসেবে। লগারিদমিক স্কেলে ১ ইউনিট বৃদ্ধি মানে আগের মানের একটি নির্দিষ্ট গুণ বাড়ানো। উদাহরণস্বরূপ একটি ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তি ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের তুলনায় প্রায় ৩২ গুণ বেশি। অর্থাৎ ৫ থেকে ৬ মাত্রা বৃদ্ধি মানে ৩২ গুণ বেশি)।

প্রতি ১ ইউনিট বৃদ্ধির সঙ্গে শক্তি প্রায় ৩২ গুণ বৃদ্ধি পায়। ২ ইউনিটের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে, যেমন ৫ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৫ পর্যন্ত, শক্তি প্রায় এক হাজার গুণ বেড়ে যায়। তাই ছোটখাটো ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে বা চাপ কমাতে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না।

প্রশ্ন

সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো ঘনবসতি অঞ্চলের কাছাকাছি ঘটেছে। যদি বড় ধরনের মেগাথ্রাস্ট ভূমিকম্প ঘটে আপনার মডেলের ভিত্তিতে ঢাকার আশপাশের কোন কোন অঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হবে? ঢাকার অনেক অংশ শতাব্দী ধরে জমে থাকা নরম নদীবাহিত পললের ওপর তৈরি। ভূমিকম্পের সময় এই নরম মাটি কীভাবে কম্পন বাড়াতে পারে?

মাইকেল স্টেকলার: যখন ভূমিকম্পের তরঙ্গ এমন মাটিতে প্রবেশ করে, যার পরিবহন ক্ষমতা কম, ধরুন সেটা নরম পলল, তখন তার কম্পনের মাত্রা বেড়ে যায়। এ ছাড়া যদি ভূমিকম্পের তরঙ্গ কোনো অববাহিকার মধ্যে বাধাপ্রাপ্ত হয়, কিছু নির্দিষ্ট কম্পনের ফ্রিকোয়েন্সি আরও শক্তিশালী হয়ে যায়।

সমগ্র বঙ্গীয় অববাহিকা এত বড় যে সেখানে বৃদ্ধি পাওয়া কম্পনের ফ্রিকোয়েন্সি সম্ভবত ভবনগুলোতে প্রভাব ফেলার মতো নয়। তবে ছোট অববাহিকা, যেমন সিলেটের পাহাড়ের মধ্যে উপত্যকাগুলো, ভবনগুলোতে প্রভাব ফেলার ফ্রিকোয়েন্সিতে কম্পন বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা আছে কি না, তা আমার জানা নেই।

আরেকটি বিষয় হলো, বিশেষ করে বর্ষার সময় অগভীর, দুর্বল পলল, বিশেষ করে বালু, তরলের মতো হয়ে যেতে পারে এবং শক্তি হারাতে পারে। এটি এই ভূমিকম্পের সময় ঢাকায় ভবনগুলো সামান্য হেলে যাওয়ার কারণ হতে পারে।

আমার ছাত্র হাসনাত জামান (বর্তমানে বরিশাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক) তাঁর মাস্টার্স থিসিসে এটি নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং ঢাকায় তরলীকরণের ঝুঁকি বেশ আছে, তা মানচিত্রে দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কঠিন মধুপুর লালমাটি অঞ্চল ভালো, তবে মানুষ নির্মাণের জন্য ভরাট করে যেসব জায়গা করছে, সেসব সাম্প্রতিক জমা হওয়া দুর্বল মাটি।

আমার ধারণা হলো, ঢাকায় কোনো ভবন ডিজাইন করার সময় ধরে নেওয়া উচিত যে ওপরের ২ থেকে ৩ মিটার মাটি তরল হয়ে যেতে পারে, তাই তার নিচের ভিত্তি অবশ্যই এমন সুরক্ষিত হতে হবে, যাতে তা পুরো ভবনকে ধরে রাখতে পারে।

প্রশ্ন

ঢাকায় বিশেষ করে ভবনের নকশা ও জরুরি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কোন কোন তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

মাইকেল স্টেকলার: একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভবনের নকশা–সংক্রান্ত নিয়ম কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা। পুরোনো ভবনকে ভূমিকম্প-সহনীয় করতে উন্নত করা অনেক ব্যয়বহুল, কিন্তু নতুন ভবনের ক্ষেত্রে খরচ খুব বেশি না বাড়িয়েই তা আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। যদি মানুষ এই অতিরিক্ত খরচ মেনে নিতে রাজি হয়, তাহলে ঢাকা আগামী কয়েক দশক থেকে এক শ বছরের মধ্যে আরও স্থিতিশীল ও ঝুঁকি-প্রতিরোধী শহর হয়ে উঠতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় মৃত্যুর হার কমানোও প্রায় একইভাবে কয়েক দশক সময় নিয়েছিল।

প্রশ্ন

আপনার জিপিএস এবং ভূতাত্ত্বিক তথ্যের ভিত্তিতে কি আমরা সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট ফল্ট বা ইন্দো–বার্মা পর্বতমালার নিচের লকড মেগাথ্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি? এই উৎসগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আমরা কতটা নিশ্চিত হতে পারি?

মাইকেল স্টেকলার: এই ভূমিকম্পটি একটি ফল্টে ঘটেছে, যা কয়েক কিলোমিটার মাটির নিচে চাপা আছে। আমরা সরাসরি এই ফল্টগুলো চিহ্নিত করতে পারি না, তবে বিকৃতি বা ডিফর্মেশনের হার কম হওয়ায় এ ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কাও তুলনামূলকভাবে কম।

বড় বড় চ্যুতির মধ্যে বড় ভূমিকম্প (রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রা পর্যন্ত) ঘটার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা রয়েছে। সিলেট, ত্রিপুরা এবং চট্টগ্রাম পাহাড়ের সব স্তর এই চ্যুতির ওপর ধীরে ধীরে আকৃতি বদলাচ্ছে। আর এই পাহাড়ের বেশির ভাগ বা সবগুলো থ্রাস্ট ফল্টের (ভূত্বকের ফাটল) সঙ্গে যুক্ত, যা ৭ মাত্রা বা তার চেয়েও বড় ভূমিকম্প ঘটাতে সক্ষম হতে পারে।

প্রশ্ন

ঢাকার আশপাশে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ঘটনাগুলোকে দেখে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতের ভূমিকম্পের সময়কাল, মাত্রা এবং সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে কী শিক্ষা নিতে পারে? এই তথ্যগুলো কীভাবে পরিকল্পনা ও ঝুঁকি কমানোর কাজে লাগানো উচিত?

মাইকেল স্টেকলার: ভবিষ্যতে মেগাথ্রাস্টে বা বড় চ্যুতির জায়গায় বড় ভূমিকম্প হতে পারে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে, আবার নাও হতে পারে। আমরা সবাই আশা করি এটি দেরিতে হবে।

বাংলাদেশের অন্যান্য জরুরি সমস্যা আছে। তাই ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে কত সম্পদ ব্যয় করা উচিত—এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। তবে যে কাজগুলো করা খুব জরুরি এর মধ্যে আছে জনসাধারণকে তথ্য প্রদান করা। যাতে তারা বাড়ি ও ভবন আরও ভূমিকম্প-সহনীয় করার অতিরিক্ত খরচ মেনে নিতে পারে।

পরিকল্পনায় এমন খোলা স্থান রাখা উচিত এবং কিছু রাস্তা এমনভাবে তৈরি করা দরকার, যাতে ধ্বংসাবশেষে সেগুলো রুদ্ধ না হয়ে যায়। সাধারণভাবে তৈরি হওয়া কলাম ও স্ল্যাবের আয়তাকার ভবন ভূমিকম্পে ভালো কাজ করে না।

তবে কিছু নকশার পরিবর্তন সাহায্য করতে পারে—যেমন জোড়াগুলো মজবুত করা, তির্যক উপাদান ব্যবহার এবং শিয়ার ওয়াল (ভবনের নিচতলার কার পার্কিংয়ের জন্য যে খোলা কলামগুলো আছে সেগুলোর ফাঁকে ইটের দেওয়াল তুলে দেওয়া)। এ বিষয়ে আরও অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন।

প্রশ্ন

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মাইকেল স্টেকলার: আপনাকেও ধন্যবাদ।