
আব্দুল হাসিব চৌধুরী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহ-উপাচার্য ও তড়িৎ ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক। তিনি জাতীয় স্বার্থসম্পর্কিত নীতি ও কৌশল নিয়ে বিভিন্ন তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান, ছাত্ররাজনীতি, সংস্কার, নির্বাচন—এসব বিষয়ে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম
গত বছর জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় শিক্ষক হিসেবে আপনি বেশ সক্রিয় ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেছে। কারও কারও মতে, গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এ ক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান লক্ষ্য আসলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ছিল না; এই কথা আলাদাভাবে বা সমান্তরালভাবে এসেছে হয়তো, কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের সময় এগুলো নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। খুব স্পষ্টভাবে গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন।
গত বছর জুলাই-আগস্টে জনগণের ওপর নৃশংসভাবে হামলা করা হয়েছে, হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। যারা এটা করেছিল, তাদের একটি রাজনৈতিক পরিচয় ছিল; একই সঙ্গে যে সরকার এটা করেছে, তারা ছিল ভারতের একটা তাঁবেদার সরকার। জনগণের ওপর আক্রমণ পরিচালনা ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের পর তারা হয়ে গিয়েছিল দখলদার। সেই দখলদার সরকারকে উচ্ছেদ করাই ছিল গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য।
রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা যদি বলেন, তাহলে সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির মধ্যে থাকতে হয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এখানে সে রকম কিছু ছিল না। যদি ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের কিছু জায়গা ছিল, পরিষ্কার অনেকগুলো পয়েন্ট ছিল। ছাত্র, শ্রমিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, নারীদের প্ল্যাটফর্ম থেকেও সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি ও কর্মসূচি ছিল। সেগুলো হয়তো বাস্তবায়িত হয়নি, সেটা ভিন্ন বিষয়, কিন্তু সেটা ছিল। কিন্তু এবার এ রকম কোনো সম্মত দাবি ও কর্মসূচি ছিল না। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের এটা সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
বাংলাদেশে বেশির ভাগ ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা। কিন্তু এবারের গণ-অভ্যুত্থানে সেটা অনুপস্থিত ছিল। এটাও গণ-অভ্যুত্থানের একটা দুর্বল দিক।
অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য মোট ১১টি কমিশন করেছিল। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে কোনো কমিশন করেনি। তার মানে কি আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন নেই?
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: এই যে ১১টি কমিশন হয়েছে, সেগুলো কিসের ভিত্তিতে হয়েছে, সেটা কিন্তু আমরা জানি না। সরকার কোন উদ্দেশ্য সামনে রেখে এবং কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংস্কার করতে চাইছে, সেটাও পরিষ্কার নয়। কমিশনগুলো গঠনের ক্ষেত্রে জনস্বার্থ কতটা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, সেই প্রশ্নও করা যেতে পারে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য—দুটো খুবই গণসম্পৃক্ত বিষয়; একই সঙ্গে এগুলো হচ্ছে জটিল ও ঝামেলাপূর্ণ ক্ষেত্র। সরকারের দিক থেকে ইমিডিয়েট যেসব সংস্কারের কথা চিন্তা করা হয়েছে, সেখানে হয়তো শিক্ষা অগ্রাধিকার পায়নি।
শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার করতে হলে প্রথমেই আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষার উদ্দেশ্যটা কী? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হলে শিক্ষার্থীরা উৎপাদনক্ষেত্রে সক্রিয় হবে। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো উৎপাদনক্ষেত্রে সক্রিয় হওয়ার মতো নয়। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের উৎপাদনের জন্য উপযোগী করে তৈরি করতে পারছে না।
শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের প্রশ্নটা এককভাবে শুধু শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এবং শিক্ষার জন্য শিক্ষা বলে আসলে কিছু নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার করতে হলে তা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির সঙ্গে মিলিয়ে তা করতে হবে। এই জায়গায় আসলে আমরা অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি।
আমাদের অর্থনীতির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীদের একটা অংশ ব্যাংক লুট, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দখলদারি, চাঁদাবাজির মাধ্যমে সম্পদের মালিক হয়েছে। এগুলো হচ্ছে অনুপার্জিত সম্পদ। উৎপাদন ক্ষেত্রে কোনোভাবে সক্রিয় না থেকে অনেকেই এভাবে পুঁজি ও সম্পদের মালিক হয়েছে। অর্থনীতির এই ধারা চলমান থাকলে শিক্ষাক্ষেত্রেও আসলে উপযুক্ত সংস্কার করা সম্ভব নয়।
এরপরও শিক্ষাক্ষেত্রে ছোটখাটো কিছু সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার করতেই পারত। আমাদের বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ হয়, জিডিপির অংশ হিসেবে সেটা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। অন্তর্বর্তী সরকার এই বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে পারত। এটা একটা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করত। এ রকম হলে পরবর্তী সরকারগুলোর পক্ষে এই ধারা থেকে সরে আসা কঠিন হতো।
রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না কিংবা সংস্কারের যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সব খারাপ হচ্ছে—এ রকম বলতে চাই না। কিন্তু এখানে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বা তাদের মতামতের গুরুত্ব নেই। আসলে সংস্কারটা এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে জনগণ নিজেদের ক্ষমতায়িত মনে করে। কিন্তু এ বিষয়টা এখানে পুরোপুরি অনুপস্থিত।
রাজনীতি ও অর্থনীতির আলাপের পাশাপাশি আমরা একটু সংস্কৃতি নিয়েও কথা বলি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মব ভায়োলেন্স এবং ট্যাগিং কালচারের ব্যাপক বিস্তৃতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এ বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: ট্যাগিংয়ের যে কালচারটা দেখছেন, এটা হঠাৎ করে হয়নি। ট্যাগিংটা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এর আগে যে সরকার ছিল, তারা তাদের বিরোধীদের অনেক সময় বিএনপি-জামায়াত বলে ট্যাগ দিত। বিষয়টা এমন ছিল, সরকারের বিরোধিতা করাই হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত হয়ে যাওয়া। গণ-অভ্যুত্থানের পরও এই ট্যাগিং কালচার অব্যাহত রয়েছে। আকস্মিক একটা পরিবর্তন হলেও দেশে নানা রকম অস্থিরতা রয়ে গেছে এবং পুরোনো জমানার অনেক কিছুর প্রতিফলনও ঘটছে। তবে আমি মনে করি, এগুলো দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
মবের ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করে বলতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশে জনগণের মধ্যে একটা বঞ্চনা বা বেইনসাফির বোধ রয়ে গেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এখানে অনেক হত্যাকাণ্ড বা নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর কোনো বিচার জনগণ পায়নি। এখানকার আইনি কাঠামো, বিচারব্যবস্থা যেভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে জনগণের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন। ফলে অনেক সময় সুযোগ পেলে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রের পুলিশি ব্যবস্থা যখন দুর্বল হয়ে যায়, তখন এগুলো বেশি বেশি ঘটে।
তবে এমন কিছু মব আছে, যেগুলো আবার পরিকল্পিত। বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে এলে এই পরিকল্পিত মবও বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, সাধারণভাবে এসব কর্মকাণ্ডে জনগণের সমর্থন নেই।
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। একজন শিক্ষক এবং রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি হিসেবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ রাখার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের একটি সুনির্দিষ্ট পটভূমি রয়েছে। এখানে একটা অচিন্তনীয় ও অমানবিক ঘটনা ঘটেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র তাঁদেরই সহপাঠী বা হলমেটকে পিটিয়ে মেরে ফেলেন। যাঁরা এই নৃশংস কাজ করেছিলেন, তাঁদের একটা দলীয় পরিচয় ছিল। তাঁরা ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বিগত সরকারের আমলে বুয়েটসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ছাত্ররাজনীতি চলেছে, সেটাকে ছাত্ররাজনীতি নয়, বরং ছাত্রলীগের রাজনীতি বলতে হবে। ফলে বুয়েটে যখন শিক্ষার্থীরা বললেন যে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে, তাঁরা আসলে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করেছিলেন। তাঁরা তাঁদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা থেকেই তখন এমন দাবি করেছিলেন। এটা কোনো স্থায়ী বিষয় নয়।
গত বছর জুলাই-আগস্টে যখন রাস্তায় নামার দরকার হয়েছে, আমাদের এই ছাত্রছাত্রীরা তখন আন্দোলনে নামতে দ্বিধা করেননি। এটা তো রাজনৈতিক কাজই ছিল। তাঁরা আসলে পুরোনো কায়দার ছাত্ররাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেখানে ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল হিসেবে তাদের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।
ছাত্ররাজনীতির কারণে শিক্ষাঙ্গনে নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড আমরা দেখেছি। আমরা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর কথা জানি। কিন্তু এসবের জন্য শুধু ছাত্রসংগঠনগুলো দায়ী, নাকি শিক্ষকরাজনীতিরও ভূমিকা রয়েছে?
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে শিক্ষকরাজনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যেকোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতেই পারেন। কিন্তু তাঁকে দলীয় রাজনীতি করতে হলে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গিয়ে করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতিকে প্রাধান্য দেওয়া, নানা রকম কায়দাকানুন বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করা এবং ব্যক্তিগতভাবে সুযোগ-সুবিধা নেওয়া—এগুলো শিক্ষকরাজনীতির একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে পরিষ্কার ঘোষণা বা নির্দেশনা থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও রাজনীতিতে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশ গুপ্তরাজনীতির জন্য উপযুক্ত কোনো দেশ নয়। বাংলাদেশ হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানের দেশ। গণ-অভ্যুত্থানের দেশে গুপ্তভাবে রাজনীতি করা যায় না। এখানকার সমাজের যে বৈশিষ্ট্য ও মানুষের প্রতিরোধের যে ধরন, তার সঙ্গে গুপ্তরাজনীতি যায় না। এ কারণে এ ধরনের রাজনীতি এখানে টেকসই হবে না। এখানে রাজনীতি করতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে, প্রকাশ্যে যেতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে একটি বহুল আলোচিত বিষয় হলো গুপ্তরাজনীতি। সাধারণ ছাত্র পরিচয় দিয়ে বিশেষ কোনো সংগঠনের হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার কৌশলকে গুপ্তরাজনীতি বলা হচ্ছে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা ক্যাম্পাসগুলোতেও এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলছে বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন। এই গুপ্তরাজনীতি নিয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: হুবহু একই রকম না হলেও এ অঞ্চলে গোপন বা আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির চর্চা আগেও হয়েছে। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করেছে। তাই এটা একেবারে নতুন কিছু নয়। আগে বামপন্থীরা এ রকম রাজনীতির চর্চা করেছে, এখন দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে কেউ কেউ ভিন্ন পন্থায় সেটা করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গুপ্তরাজনীতি বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে, সেটা কিন্তু নানা কারণে অনৈতিক। এমন অনেকের কথা এখন শোনা যাচ্ছে, যাঁরা বিগত আমলে ছাত্রলীগের মধ্যে থেকে গুপ্ত রাজনীতি করেছেন। এ রকমটা হলে ছাত্রলীগের সেই সময়ের কর্মকাণ্ড এবং অপকর্মের দায়ভারও তাঁদের নিতে হবে। কারণ, তাঁরা গুপ্তভাবে অন্য সংগঠনে থাকলেও প্রকাশ্যে তো ছাত্রলীগে ছিলেন, ছাত্রলীগের পক্ষে স্লোগান দিয়েছেন।
গুপ্তরাজনীতিকে আলাদাভাবে প্রতিরোধ করার কিছু নেই। এটা স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, বাংলাদেশ গুপ্তরাজনীতির জন্য উপযুক্ত কোনো দেশ নয়। বাংলাদেশ হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানের দেশ। গণ-অভ্যুত্থানের দেশে গুপ্তভাবে রাজনীতি করা যায় না। এখানকার সমাজের যে বৈশিষ্ট্য ও মানুষের প্রতিরোধের যে ধরন, তার সঙ্গে গুপ্তরাজনীতি যায় না। এ কারণে এ ধরনের রাজনীতি এখানে টেকসই হবে না। এখানে রাজনীতি করতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে, প্রকাশ্যে যেতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের কর্মসূচি নিয়ে কথা বলতে হবে এবং সেটা নিয়েই গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ অর্থাৎ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। একসময় বুয়েটেও প্রায় নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। বুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে কি কিছু ভাবছেন?
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: বুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে কি না, সেটা নির্ভর করছে শিক্ষার্থীদের চাওয়ার ওপর। বুয়েটের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি আছে। তাই শিক্ষার্থীরা চাইলে নির্বাচন হবে। আমাদের দিক থেকে এটা নিয়ে কোনো বাধা নেই, বরং আমরা চাই শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করুন। কিন্তু ফ্রেমওয়ার্কে থাকা সত্ত্বেও ছাত্ররা যদি আন্তরিকভাবে নির্বাচন না চান, তাহলে আমরা কিছু করতে পারব না।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকে একটু জাতীয় নির্বাচনের আলাপে আসি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। এরপরও বিভিন্ন তরফ থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে। এ রকম সন্দেহ-সংশয়ের কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে কি মনে করেন?
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: একেকটা দল এলে একেক রকম পারসপেক্টিভ থেকে রাজনীতি করে এবং সেভাবেই তাদের কৌশল সাজায়। তাই নির্বাচন নিয়েও বিভিন্ন দল বিভিন্ন রকম কথা বলছে। এটা হয়তো তাদের দর-কষাকষিরও একটা অংশ। নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের যৌক্তিক কোনো কারণ রয়েছে কি না, সে বিষয়ে মন্তব্য করা আমার জন্য কঠিন। তবে আমি যেটা বুঝি, তা হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ আসলে নির্বাচন চান।
গত ১৫ বছরে দেশে আসলে কোনো নির্বাচন হয়নি, মানুষ ভোট দিতে পারেননি। এই ভোট দিতে না পারাটাও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ। জনগণের ভোটাধিকারটাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা হয়েছিল—এটা বাংলাদেশের জনগণ কোনোভাবে মেনে নিতে পারেননি। এর ফলে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হতে হবে।
আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ ও ভারত বাংলাদেশে নির্বাচন চায় না। আওয়ামী লীগ ও ভারতের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে নির্বাচন বানচাল করা। গত ১৫ বছর তারা যেমন নির্বাচন হতে দেয়নি, সেটাই তারা জারি রাখতে চায়। কারণ, নির্বাচন না হলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়বে এবং দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এসবের একটা জবাব হতে পারে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। কোনো ইস্যুতে ঐকমত্য না হলে নির্বাচন কি পিছিয়ে যেতে পারে?
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: আমি বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখি। ঐকমত্য কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে, কিন্তু তারা কি এসব বিষয়ে জনগণের সম্মতি বা মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে? এসব বিষয়ে জনগণের অংশগ্রহণে দেশব্যাপী খোলামেলা আলোচনার আয়োজন করা দরকার ছিল। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে এখানে সংস্কার হতে পারত, কিন্তু সেটা হয়নি। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কয়েকজন ভদ্রলোক সংস্কার করে দেবেন আর জনগণকে সেটা মেনে নিতে হবে। এ ধরনের মনোভাব সংস্কারপ্রক্রিয়ার একটি বড় দুর্বলতা।
রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না কিংবা সংস্কারের যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সব খারাপ হচ্ছে—এ রকম বলতে চাই না। কিন্তু এখানে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বা তাদের মতামতের গুরুত্ব নেই। আসলে সংস্কারটা এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে জনগণ নিজেদের ক্ষমতায়িত মনে করে। কিন্তু এ বিষয়টা এখানে পুরোপুরি অনুপস্থিত।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আব্দুল হাসিব চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।
[২৪ আগস্ট, ২০২৫ প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় এ সাক্ষাৎকারটি ‘জনগণের অংশগ্রহণ না থাকা সংস্কারের বড় দুর্বলতা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।]