
মাহদী আমিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা। গণমাধ্যমে দেওয়া তারেক রহমানের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার, বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি, বিদ্রোহী প্রার্থী, তরুণদের মধ্যে দলটির গ্রহণযোগ্যতা—এসব বিষয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া ও মনোজ দে
প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সরাসরি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তারেক রহমান। সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচন, সংস্কার, আওয়ামী লীগের বিচার, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। তাঁর এই সাক্ষাৎকার বিএনপিকে কতটা উজ্জীবিত করেছে বলে মনে করেন?
মাহদী আমিন: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বিবিসি বাংলা ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দুটি সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট একটা রূপকল্প ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা মনে করি, শুধু বিএনপি নয়, বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁর বক্তব্যকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো বাংলাদেশে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান থাকবে, পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকবে, সবার আগে বাংলাদেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব আসবে।
তারেক রহমান তাঁর সাক্ষাৎকারে এটিই বলেছেন। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের যাঁরা রয়েছেন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের প্রতি একটিবারের জন্যও তিনি অসৌজন্যমূলক শব্দচয়ন করেননি। ন্যায়বিচার ও আইনের অনুশাসনের কথা বলেছেন। সুতরাং বর্তমান বাংলাদেশে আমরা সবাই মিলে যেভাবে একটি উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি নিশ্চিত করতে চাই, তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে।
চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর বিএনপির নেতা–কর্মী ও নাগরিকদের একটি বড় জিজ্ঞাসা হলো তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন। সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, খুব শিগগিরই দেশে ফিরবেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন; কিন্তু নির্বাচনের তো আর মাত্র চার মাস বাকি। এই শিগগিরইটা আসলে কবে? তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে এখনো কোনো অনিশ্চয়তা আছে কি?
মাহদী আমিন: তারেক রহমান স্পষ্টভাবে বলেছেন, নির্বাচনের আগেই তিনি দেশে ফিরবেন। তিনি বলেছেন, এই গণ–অভ্যুত্থান, যার কারণে আজ আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি এর মাস্টারমাইন্ড জনগণ। সব শ্রেণি, পেশা ও স্তরের মানুষ যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে ভূমিকা রেখেছিলেন বলেই আজ আমরা এভাবে মুক্তভাবে কথা বলতে পারছি। তাঁর যে ত্যাগ, সংগ্রাম সেটি তো জনগণের জন্যই। তিনি, তাঁর পরিবার, তাঁর দল, তাঁর নেতা–কর্মী এবং সাধারণ মানুষ সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে সংগ্রাম করেছিলেন, তার বিনিময়ে অর্জিত মুক্ত বাংলাদেশে তিনি জনগণের মাঝে ফিরে আসবেন, সেটিই তো স্বাভাবিক। আমরা মনে করি, খুব দ্রুত—নির্বাচনের আগেই তিনি দেশে ফিরবেন ও নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
মানুষের মাঝে একটি আলোচনা আছে যে নির্বাচনের ব্যাপারে সরব থাকলেও নির্বাচনের প্রস্তুতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর তুলনায় বিএনপি পিছিয়ে পড়েছে। এটিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মাহদী আমিন: প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ভিন্ন কৌশল থাকবে, ভিন্ন অবস্থান থাকবে। আপনারা যে রাজনৈতিক দলের কথা বললেন, তারা কৌশলগতভাবে সব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। বিএনপি গত ১৬-১৭ বছরে গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার অংশ হিসেবে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সবার মতামতের ভিত্তিতে এবং জনসম্পৃক্ততার বিচারেই বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। সুতরাং যখন আমাদের প্রার্থীদের মনোনয়ন ঘোষণা করা হবে, স্বাভাবিকভাবে তখন থেকেই আমরা সাংগঠনিকভাবে আরও অনেক বেশি নির্বাচনমুখী হয়ে উঠব; কিন্তু এই মুহূর্তে যেসব নেতা সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকে কিন্তু জনসম্পৃক্ততা গড়ে তুলছেন।
৫ আগস্টের পর বিএনপি অনেকগুলো সমাবেশ করেছে। বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এসব সমাবেশে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে। তরুণদের টার্গেট করে তারুণ্যের সমাবেশ ও সেমিনার হয়েছে। এসব কর্মসূচিতেও দল ও দলের বাইরে বিভিন্ন মত ও পথের তরুণদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে। সুতরাং আমরা হয়তো আসনভিত্তিক নির্বাচনী যাত্রা শুরু না করলেও কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আমাদের নির্বাচনী কার্যক্রম জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চালু রয়েছে।
বিএনপির প্রার্থী আসলে কে, সেটি প্রায় কোনো আসনেই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। বেশির ভাগ আসনেই তিন, চার কিংবা আরও বেশিসংখ্যক সম্ভাব্য ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁরা প্রার্থী হতে চান। সবাই নিজেদের মতো করে প্রচারণায় নেমেছেন। এতে তো বিএনপির সমর্থকেরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, নাগরিকেরাও বিভ্রান্ত। এবার প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে বিএনপি কি আগের ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারবে?
মাহদী আমিন: তারেক রহমান তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রার্থী বাছাই করা হবে দলের ভেতরে গ্রহণযোগ্যতা ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিচারে। এর অংশ হিসেবে গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় যাঁরা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সংগ্রাম করেছেন, তাঁদেরকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি রাজনৈতিক দলের ভেতরে অনেক প্রার্থী থাকবেন, সেটিই স্বাভাবিক।
বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ওপর থেকে চাপিয়ে দিতে চায় না। দলের ভেতরে কার কতটা গ্রহণযোগ্যতা ও জনসম্পৃক্ততা, সেটি যাচাইয়ের জন্য বিএনপি অভ্যন্তরীণ জরিপ পরিচালনা করছে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে প্রার্থী ঘোষণা করতে হয়তো কিছুটা সময় লাগছে। আমরা আশা করি, নির্বাচনী তফসিলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সব আসনে সঠিক সময়ে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে।
এই যে অনেকগুলো আসনে প্রার্থীর সংখ্যা যে অনেক বেশি, এটিও বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিমত্তারই বহিঃপ্রকাশ। নেতৃত্বের জায়গা থেকে অনেকেই মনে করেন, দলের কাছ থেকে মূল্যায়নের একটি মাধ্যম হচ্ছে নির্বাচনের মনোনয়ন প্রাপ্তি। অনেকের জন্যই এটি তাঁর সাংগঠনিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং অনেক বেশি নেতা মনে করছেন, দলের এই মূল্যায়নটুকু তাঁরা পেতে পারেন; কিন্তু যখন দল থেকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়ে যাবে, তখন সব বিভেদ ও বিভাজন ভেঙে, প্রতিযোগিতা এক পাশে রেখে তাঁরা দলের জন্য কাজ করবেন—সেটি আমরা বিশ্বাস করি।
বিএনপির রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ‘ব্যক্তির চাইতে দল বড়, দলের চাইতে দেশ বড়’ এই বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে। আওয়ামী লীগের আমলে লোভ-লালসা, ভীতি, হামলা, মামলা উপেক্ষা করে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ ছিল। আমরা বিশ্বাস করি, মনোনয়নের ঘোষণার পর সেই ঐক্যকে ধারণ করে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সবাই একসঙ্গে দলের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবেন।
আপনি বলছেন, অনেক আসনে অনেক প্রার্থী থাকলেও মনোনয়ন দেওয়ার পর সবাই মিলেমিশে কাজ করবেন; কিন্তু এটা তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব কঠিন একটি কাজ। এরই মধ্যে আমরা দেখছি, বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে প্রাণহানিও হচ্ছে। বিদ্রোহী প্রার্থী মানেই তো ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত এই বিদ্রোহকে কতটুকু সামাল দিতে পারবেন? বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাপারে বিএনপি কতটা উদ্বিগ্ন?
মাহদী আমিন: আমি যতটুকু বুঝি, বিদ্রোহীদের ব্যাপারে বিএনপির উদ্বেগ নেই, তবে একটি উপলব্ধি আছে। বাস্তবতা হচ্ছে অনেক ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। দলের ভেতরে কিন্তু কোনো ভাঙন তৈরি হয়নি। সুতরাং বিএনপির মধ্যে বড় একটি ঐক্যের জায়গা তো আছেই। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সেই ঐক্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।
আজ হয়তো আমরা দেখতে পাচ্ছি নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন প্রার্থী যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে মনোনয়ন চাইছেন; কিন্তু বিএনপি বিশ্বাস করে, যখন দল থেকে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রায় সব নেতা–কর্মী এবং সমর্থকেরা সেই প্রার্থীর সঙ্গেই কাজ করবেন। যদি কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটে, সে ক্ষেত্রে দলের নেতৃত্ব থেকে নির্দেশনা আসবে। সাংগঠনিকভাবে তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা মীমাংসায় পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আমরা আশাবাদী।
মনোনয়নের ক্ষেত্রে এবার নতুন মুখ কিংবা তরুণদের কি প্রাধান্য দেওয়া হবে?
মাহদী আমিন: আমি যতটুকু জেনেছি, দলের বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ নেতাদের পাশাপাশি যাঁরা দক্ষ, যোগ্য ও জনপ্রিয়, সেই তরুণদেরও মূল্যায়ন করা হবে। যাঁরা বিএনপিতে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদল, যুবদল স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন; তাঁরা ত্যাগ, সংগ্রাম ও জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে অবশ্যই প্রার্থী হিসেবে উঠে আসবেন।
পরিবারতন্ত্র আমাদের রাজনীতির একটি বড় সমস্যা। সংবাদমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি আসনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের কয়েকজন মনোনয়ন চাইছেন, আবার তাঁদের ছেলেমেয়েদের জন্যও আসন চাইছেন; কিন্তু রাজনীতিতে তো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই একজন নেতা হয়ে ওঠেন। নেতার সন্তান বলেই কি একজন অগ্রাধিকার পাবেন?
মাহদী আমিন: এ বিষয়ে তারেক রহমান সম্প্রতি একটি বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, সব নেতার সন্তানেরা রাজনীতিতে আসেন না; আবার সব সন্তান এসে সফল হন না। রাজনীতির এই সাফল্য নির্ভর করবে কে কত সময় ধরে জনগণের সঙ্গে আছেন কিংবা জনগণ ও দলের নেতা–কর্মীরা তাঁর নেতৃত্বকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করছেন কি না।
প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এই দুইয়ের সমন্বয় করা হবে। আমরা যদি আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কথা চিন্তা করি; তিনি সেই ১৯৮৮ সাল থেকে সাংগঠনিকভাবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ৩৭ বছর ধরে রাজনীতি করে তিনি আজকের এই জায়গায় এসেছেন, সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন।
আমরা মনে করি, নেতৃত্ব বিকশিত হয় একটি রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়ে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো নেতৃত্ব বিকাশের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কেউ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছেন কি না কিংবা সাংগঠনিকভাবে সমর্থনটা আদায় করতে পেরেছেন কি না।
ডাকসু ও জাকসুতে ছাত্রদলের বড় পরাজয় হয়েছে। সাম্প্রতিক একটি জরিপও বলছে, ৩০ বছরের নিচে যাঁদের বয়স; তাঁদের মধ্যে বিএনপির প্রতি সমর্থন তুলনামূলকভাবে কম। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদলের এই বড় পরাজয়ের কারণ কী বলে মনে করেন? তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে বিএনপি কি ব্যর্থ হচ্ছে?
মাহদী আমিন: তারুণ্যকে কেন্দ্র করে বিএনপির বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। তারেক রহমান বলেছেন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে কী কী নীতি গ্রহণ করা হবে, কীভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে, শিক্ষাব্যবস্থা কেমনভাবে পুনর্গঠন করা হবে; আর কোন কোন খাতে তরুণদের জন্য সত্যিকারের সাম্য ও মর্যাদা নিশ্চিত করা যাবে—এসব নিয়েই কাজ চলছে। আমাদের নির্বাচনী রূপকল্পে তরুণদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কাজ চলছে প্রতিটি খাত নিয়েই।
আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক নির্বাচনের কথা বললেন; কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সরাসরি সম্পর্কটা তুলনামূলকভাবে কম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ১৬ বছরে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা নিজেদের নামে রাজনীতি করার কারণে একটি রাতের জন্যও হলে থাকতে পারেননি। ক্যানটিনে একটি বারের জন্য ঢুকতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা দেওয়ার বাইরে তাঁরা ক্যাম্পাসে যেতে পারেননি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একই ইকোসিস্টেমের অংশীদার হিসেবে তাঁরা সম্পর্কটা সেভাবে গড়ে তুলতে পারেননি।
অন্যদিকে কিছু রাজনৈতিক সংগঠন ভিন্ন কৌশল ও পরিচয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে, যার প্রভাব নির্বাচনে দেখা গেছে। তবে আমরা বিশ্বাস করি, এই নির্বাচনগুলো এমনভাবে হতে হবে, যাতে কোনো বিতর্ক না থাকে। এখানে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভিযোগ উঠেছে, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত।
আমরা চাই ডাকসু–জাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্রনেতারা যেন ন্যায়সংগত নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে আসেন। কারণ, আমরা তাঁদের অভিনন্দন জানাতে চাই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আহ্বান জানাব, এ ধরনের নির্বাচন যেন সম্পূর্ণ বিতর্কমুক্ত হয়। কারণ, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
মিছিল ও শোডাউনের মতো পুরোনো কর্মসূচির বৃত্তেই বিএনপিকে ঘুরপাক খেতে দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পেইনের ক্ষেত্রেও অন্য দলের তুলনায় বিএনপির দুর্বলতা দৃশ্যমানভাবে চোখে পড়ছে; কিন্তু আগামী নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা তো একটি নির্ধারক ভূমিকা রাখবেন, অনলাইন ক্যাম্পেইনে তাঁরা প্রভাবিত হন। কমিউনিকেশন স্ট্র্যাটেজির এই দুর্বলতা বিএনপিকে কতটা ভোগাবে বলে মনে করেন?
মাহদী আমিন: এটা সত্যি যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি কিছুটা পিছিয়ে আছে। হয়তো এর কারণ, গত ১৬ বছরে বিএনপির মূল মনোনিবেশটা রাজপথকেন্দ্রিকই ছিল। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারকৌশল নিয়ে বিএনপি এখন কাজ করছে। আমরা আশা করি, খুব শিগগির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপির ইতিবাচক উপস্থিতি দৃশ্যমানভাবে বাড়বে।
তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে ৫ আগস্টের পর বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে ও স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জনসম্পৃক্ত কাজের অসংখ্য উদ্যোগ নিলেও সেগুলোর খবর জনগণের কাছে সেভাবে পৌঁছানো যায়নি; কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি অপপ্রচারের শিকার হতে হয়েছে। বিএনপি বিশ্বাস করে, অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য ও চরিত্রহনন রাাজনৈতিক কৌশল হতে পারে না। আমাদের মূল কৌশল হলো যা সত্য ও ন্যায়, যা সঠিক ও বাস্তব সেটিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরা।
৫ আগস্টের পর থেকে চাঁদাবাজি, দখল—এসব অভিযোগ এসেছে বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছে শুধু মুখগুলোই বদলেছে, ব্যবস্থাটি বদলায়নি। এটা সত্যি যে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁদের প্রায় সাত হাজার নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন, কিন্তু তাতে তো বাস্তব চিত্র খুব একটা বদলায়নি। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের সঙ্গে তুলনীয় নয়; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। বিএনপির প্রতিপক্ষ সেটিকে কাজে লাগাচ্ছে। তারা বলছে, ‘আওয়ামী লীগ দেখেছেন, বিএনপি দেখেছেন, এবার আমাদের সুযোগ দেন…।’
মাহদী আমিন: বিএনপির মতো গণতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ফ্যাসিবাদী দলের তুলনা করা বিব্রতকর। ইতিহাস বলছে, আওয়ামী লীগ বাকশাল এনেছিল, ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি করেছিল আর বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করেছিল। ফ্যাসিবাদের ১৬ বছরে সবচেয়ে বেশি গুম, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তুলনা করা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টা।
দেশে একটি দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে, দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি তৈরি করতে বিএনপি প্রায় সাত হাজার নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। বিএনপির ৬০ লাখ নেতা–কর্মী মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন, এটা প্রত্যাশা করা যায় না যে এই বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মীর সবাই শতভাগ ত্রুটিহীন হবেন। তবে দল হিসেবে বিএনপি এসব অপরাধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। অভিযোগ পেলে তদন্ত করছে, প্রমাণ মিললে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে; কিন্তু সমস্যা হলো প্রকৃত ঘটনা ও অভিযোগের তুলনায় অপপ্রচার অনেক বেশি। অনেক সময় চাঁদাবাজির মতো অভিযোগ বিএনপির নামে চাপিয়ে দেওয়া হয় অথচ তদন্তে বেরিয়ে আসে—আসলে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহদী আমিন: আপনাদেরও ধন্যবাদ।