
রিদওয়ানুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা এবং গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও বিচারিক সক্রিয়তা নিয়ে তাঁর লেখা ও সম্পাদিত বই বের হয়েছে দেশের বাইরের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সংবিধান সংস্কার, জুলাই সনদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিসরে অন্যতম আলোচনা বা বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সংবিধান। অনেকেই বলছেন, বিদ্যমান সংবিধান বিগত স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। কারও কারও মতে, এর জন্য দায়ী আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ ক্ষেত্রে আসলে কোনটার দায় কতটুকু?
রিদওয়ানুল হক: এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, আমাদের সংবিধানে কিছু দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে; কিন্তু শুধু এই দুর্বলতার কারণেই স্বৈরশাসনের উত্থান হয়েছে বলে আমি মনে করি না। গণতান্ত্রিক সংবিধান আছে, এমন কিছু দেশেও সম্প্রতি স্বৈরাচারী সরকার বা সরকারপ্রধানের উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরের ১৫–১৬ বছরে আমাদের দেশে গণতন্ত্র পেছন দিকে চলতে শুরু করে, যেটিকে আমরা ‘ডেমোক্রেটিক ব্যাকস্লাইডিং’ বলি। একপর্যায়ে এটি স্বৈরাচারী শাসনে পরিণত হয়।
এ ক্ষেত্রে সংবিধানের চেয়ে আমি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বেশি দায়ী করব। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব আছে; দলের ভেতরে ব্যক্তিপূজা বা এক ব্যক্তিকে সর্বময় ক্ষমতার মালিক করার মতো বিষয় রয়েছে। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার পেছনে সংবিধানের চেয়ে এ বিষয়গুলোর ভূমিকাই বেশি।
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিয়েছে। গণ–অভ্যুত্থানের পক্ষের কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বা তাত্ত্বিক বিভিন্ন সময় এটিকে ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
রিদওয়ানুল হক: একজন ব্যক্তি কীভাবে সংবিধানকে বুঝতে চান, সেটি অনেকটাই নির্ভর করে কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলোকে তিনি কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চান, সেই বিষয়ের ওপর। সংবিধান নিছক সাদাকালো হরফের কোনো বই নয়, এটি তার চেয়েও বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে শপথ নিয়েছে, সেটিকে সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব বলার কোনো সুযোগ নেই বলে আমি মনে করি। এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে। প্রথমত, এটি পুরোপুরি সত্য না যে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যখন শপথ নেয়, সেই সময় সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থাই ছিল না। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও ছিল না; পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার সেটি বাতিল করেছিল। এর ফলে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল এবং দেশে তিন দিন কোনো সরকার ছিল না।
এই শূন্যতা পূরণ করতে সংবিধানের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে। তখন এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। এটিকে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার বলে সংবিধানের অলিখিত সংশোধনী বলা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা যেভাবে শপথ নেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও সেভাবে শপথ নিয়েছেন। সেই বিবেচনায় তাঁরা সংবিধান মেনেই শপথ নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা সংবিধানকে অগ্রাহ্য করেননি বা বাতিল করে দেননি। কাজেই অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এর ভিত্তি সার্বভৌম জনগণের ইচ্ছা, যাঁরা এই রাষ্ট্রের মালিক।
সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব কথাটা যাঁরা বলেছেন, তাঁরা হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন যে দেশে একটি বিপ্লব হয়েছে; এর ফলাফল হিসেবে একটি বিপ্লবী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার কথা এবং সেখানে সংবিধান কার্যকর থাকারও কথা না। এ রকম ধারণা অমূলক এবং সেই রকম কিছু হলে তা রাষ্ট্রের সাংবিধানিকতা স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ হতে পারত।
সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব নিয়ে যাঁরা বলছেন, তাঁরা কিন্তু কিছু বিষয় অগ্রাহ্য করছেন বা এড়িয়ে যাচ্ছেন। এই আধুনিক জমানায় নির্বাচন, সংবিধান পরিবর্তন—এই বিষয়গুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সরাসরি কিছু ভূমিকা থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে নতুন সংবিধান কীভাবে হবে, তা নিয়ে জাতিসংঘের কিছু দিকনির্দেশনা আছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিবেচনা হলো রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা এবং নতুন সরকারের কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে যখন একটি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল, তখনো কিন্তু আমরা সব কিছু শূন্য থেকে শুরু করিনি; সাংবিধানিক এবং আইনি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এর কারণ হলো এ রকম পরিস্থিতিতে যে বিশাল পরিবর্তন হয়, সে রকম অবস্থায় আগের কিছু ধারাবাহিকতা না থাকলে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।
দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরপর তদানীন্তন সংবিধান সভা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে, যা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সংবিধান হিসেবে কাজ করে। ২০২৪ সালে যখন গণ–অভ্যুত্থান হয়, তখন আমাদের সংবিধান বহাল ছিল। তাই গণ–অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান বাতিল হয়েছে বা বাতিল করার সুযোগ ছিল বলে আমি মনে করি না। সংবিধান বাতিল করার আগে নির্বাচন ও সংবিধানসভার প্রয়োজন রয়েছে।
সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এরপর ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হলো। তারা সংবিধানসহ কিছু বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে; কিন্তু সংবিধান নিয়ে এখনো কোনো মতৈক্য হয়নি। এই জটিলতার কারণ কী?
রিদওয়ানুল হক: যে পদ্ধতিতে বা যে প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেটিই এই জটিলতার একটি কারণ। কমিশন গঠন করা হয়েছিল ‘টপ ডাউন মডেল’ (উঁচু থেকে নিচে যাওয়া) অনুসারে। এটা যদি নিচ থেকে ওপরের দিকে আসত, অর্থাৎ জনগণ ও জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ থাকত, তাহলে হিসাব-নিকাশটা অন্য রকম হতে পারত। এখন যে জটিলতাগুলো হচ্ছে, সেটি হয়তো আগেই সমাধান করে নেওয়া যেত।
আপনি যদি সংবিধান সংস্কার কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্স বা কার্যপরিধি দেখেন, সেখানে কমিশনকে সংস্কারের জন্য সুপারিশ দিতে বলা হয়েছিল; কিন্তু সংস্কারটা কীভাবে করা হবে, সেটি কোথাও কিন্তু বলা নেই। তবে সরকার পক্ষ থেকে এবং পরবর্তী সময়ে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে যেটি বলা হয়েছে, তা হলো সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের মতৈকে৵র ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কার করা হবে; কিন্তু এরপরও কোন পদ্ধতিতে এটা হবে, তা স্পষ্ট হয়নি।
এখন যে জটিলতাগুলোর কথা জানা যাচ্ছে বা বোঝা যাচ্ছে, তার কারণ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড মতবিরোধ। কোনো দল চাইছে একেবারে নতুন সংবিধান, আবার কোনো দল বিদ্যমান সংবিধান বহাল রেখে তা সংশোধনের কথা বলছে, আরও নানা রকম প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলগুলোর অবস্থা বেশ অনড়।
আমাদের যেটা মনে রাখতে হবে, কনস্টিটিউশন ইজ দ্য ক্রিস্টালাইজেশন অব পলিটিকস। অর্থাৎ সংবিধান হলো রাজনীতির বিমূর্ত প্রতীক। যদি সংবিধান সংশোধন করতে হয়, তাহলে সেই রাজনীতির ন্যূনতম ঐকমত্য থাকতে হবে; কিন্তু সংবিধান সংস্কার নিয়ে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়নি, এটা এখন স্পষ্ট।
ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার কাজ করছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির কথা বলেছে। কেউ কেউ আবার জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপর স্থান দেওয়ার দাবি করেছে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
রিদওয়ানুল হক: জুলাই সনদের যে খসড়া প্রকাশিত হয়েছে, আমার সেটি দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি জানি যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের কথাবার্তা চলছে এবং খসড়াটিও আরেকটু পরিমার্জন করা হচ্ছে। তার মানে হলো জুলাই সনদ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু জুলাই সনদ–সংক্রান্ত যে বিষয়টি সামনে এসেছে বা আলোচিত হচ্ছে, তা হলো জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া বা সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়ার প্রশ্নটি।
আমি মনে করি, জুলাই সনদকে কোনোভাবেই সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া উচিত হবে না। আমাদের বুঝতে হবে, জুলাই সনদ কিন্তু কোনো আইন নয়। এটা একটি পলিটিক্যাল চার্টার বা চুক্তি, যা রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে হচ্ছে। তাই জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপর স্থান দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসের একটি বড় ঘটনা। ওই গণ-অভ্যুত্থানে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন, কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। এ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে যাত্রা শুরু করতে পেরেছি। এর ফলে জুলাই সনদ একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে পারে এবং সেই দাবিটা খুবই যৌক্তিক। তবে কোনোভাবেই এর সঙ্গে আইন বা সংবিধানকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না।
এর একটি সমাধান হতে পারে—সরকারি গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করা হলে সংবিধানের কোনো একটি তফসিলে এটিকে রেফারেন্স হিসেবে রাখা যেতে পারে; কিন্তু কোনোভাবেই জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া বা সেটিকে আইন হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই। সম্প্রতি ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই ঘোষণা’র দফা ২২–এর অধীন রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বা আইনি মর্যাদাদানের কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে জুলাই ঘোষণাকে সংবিধানের ওপরের সংবিধান হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
সংবিধান থেকে একটু বিচার বিভাগ প্রসঙ্গে আসি। সম্প্রতি উচ্চ আদালত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে একটি রায় দিয়েছেন। এই রায়ে বাহাত্তরের সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ যেভাবে ছিল, সেভাবে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে অধস্তন আদালত এখন থেকে সুপ্রিম কোর্টের অধীন থাকবে এবং আইন মন্ত্রণালয় বা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে, অনেকেই এমন আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। এটিকে কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়?
রিদওয়ানুল হক: ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে আদালতের রায়ের বিষয়টি আমি সংবাদপত্রে দেখেছি। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে সেটি নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। তবে সাধারণভাবে কিছু কথা বলা দরকার। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ছিল—নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। তখন আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থার সরকার ছিল।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল। এরপর জিয়াউর রহমানের আমলে এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তাতে রাষ্ট্রপতির ওপরই ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। তবে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে কাজটি করবেন—এমন একটি কথা যোগ করে দেওয়া হয়। এর ফলে পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন আসলে হয়নি।
লক্ষণীয় হলো পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার সময় বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বলেছিল, তারা বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত যেতে চায়; কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদসহ বহু ক্ষেত্রে তারা কিন্তু সেটি করেনি। আদালতের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আসলে কোনো সরকারই বিচার বিভাগের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ছেড়ে দিতে চায় না। এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের বাস্তবতা। সেই বাস্তবতায় ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে রায়টা হলো। আমি প্রথমত এটিকে সাধুবাদ জানাই। আমরা যদি এটি বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে এটি ইতিবাচক হবে।
তবে আমার একটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে—আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসংক্রান্ত যে উদ্যোগগুলো এসেছে, তার সব কটি আদালতনির্ভর। এটি একটি দুর্বলতা। রাজনৈতিক ঐকমতে৵র ভিত্তিতে কোনো সরকার বা নির্বাহী বিভাগ এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, এ রকম কোনো উদাহরণ নেই বললেই চলে। রাজনৈতিকভাবে এ রকম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে তা বিচার বিভাগের টেকসই স্বাধীনতার জন্য ভালো হতো। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আদালতের কোনো রায় তখনই ভালো রায় হিসেবে গণ্য হবে, যখন সরকার সেটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে।
আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি খুব সরলভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটা বহুধা অর্থ বহন করে এবং এর বিভিন্ন ধরনের আঙ্গিক আছে। বিচারকদের সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, স্বাধীন মনমানসিকতা, পেশাদারত্ব, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি—এ সবকিছুই বিচারিক সংস্কৃতির অংশ। সেই সংস্কৃতির চর্চা আমাদের এখানে খুব বেশি নেই। তাই শুধু সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করলে, আইনের কিছু ধারা বদল করলে, এমনকি এ–সংক্রান্ত নতুন আইন করলেও বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যাবে, বিচারকেরা স্বাধীনভাবে বিচার করবেন বা করতে পারবেন—এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
নির্বাচন প্রসঙ্গে একটু কথা বলি। অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে; কিন্তু সেই নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা যাচ্ছে। কেউ আগের পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষ, কেউ উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন) চাচইছে, কেউ আবার উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ—দুই কক্ষেই পিআর চাইছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
রিদওয়ানুল হক: বাংলাদেশে এর আগে কখনো পিআর–পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়নি। এখানকার সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামো এবং নির্বাচন নিয়ে জনগণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পিআর পদ্ধতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এরপরও উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। কিন্তু যেটা মূল সংসদ অর্থাৎ নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন কোনো ভালো সিদ্ধান্ত হবে না। এটা নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করবে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক উত্তরণে বিলম্ব ঘটাবে। এ কারণে আমি নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনকে দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতার জন্য কেউ কেউ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মতো লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের অধীন নির্বাচনের কথা বলছেন। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
রিদওয়ানুল হক: ১৯৭০ সালের বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতা এক নয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়েছিল সামরিক শাসনের অধীন; তখন কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থা চলমান ছিল না। সে কারণে একটি নতুন সংবিধান তৈরির জন্য কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি প্রয়োজন ছিল। তাই লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের অধীন নির্বাচন হয়েছিল। বাংলাদেশের এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে সেটি তুলনীয় নয়। আমরা কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির নির্বাচন বা গণভোট করতে পারি। তবে সেটির জন্য সুস্পস্ট রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে।
বেশ কিছুদিন ধরে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী মাঠে আছে। সেনাবাহিনীর পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকম কথাবার্তা বলা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কী?
রিদওয়ানুল হক: রাজনীতি, সংবিধান বা এই রকম যেকোনো আলোচনায় আমরা সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনেক সময়ই এড়িয়ে চলি। আবার সেনাবাহিনী নিয়ে আমরা অনেক ধরনের গুজবও শুনে থাকি। এটা আমাদের একধরনের পলিটিক্যাল কালচার। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে যেকোনো কঠিন বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে।
একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতী সরকার কোনো নির্বাচিত সরকার নয়। এই সরকার অবৈধ বা অসাংবিধানিক না হলেও নির্বাচিত সরকার না হওয়ার কারণে এর কিছু দুর্বলতা রয়েছে। এরই মধ্যে সরকার নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছে। আমরা আগে দেখেছি, নির্বাচনের ঘোষণা এলেই বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে সেনা মোতায়েনের দাবি আসত। এ থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর সেনাবাহিনীর প্রতি একধরনের আস্থা রয়েছে।
আগামী নির্বাচনের একটি বড় বিষয় হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তার মানে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণেও সেনাবাহিনীর একটি স্টেক তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে ভূমিকা রাখতে হচ্ছে। তাদের ভূমিকাগুলোকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। সেনাবাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে—এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রিদওয়ানুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।