আমাদের চারপাশে প্লাস্টিক আজ আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে চারপাশে তাকালেই প্লাস্টিক ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজার ব্রাশ থেকে শুরু করে, টিফিন বক্স, পানির বোতল, বাজারের ব্যাগ, খাবারের মোড়ক—এমনকি কাপড়ের ফাইবার, সবখানেই প্লাস্টিক। একসময় মানুষ ভাবত, প্লাস্টিক ছাড়া চলাই কঠিন। কারণ, এটা হালকা, টেকসই, পানিতে নষ্ট হয় না, দামও কম। কিন্তু আজ সেই প্লাস্টিকই আমাদের জন্য অভিশাপে পরিণত হচ্ছে।
প্লাস্টিক প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল ১৯০৭ সালে। তখন মানুষ খুব খুশি হয়েছিল। কারণ, এটা দিয়ে অনেক কিছু তৈরি করা যায়। মাটির হাঁড়ি ভেঙে যায়, কাগজ নষ্ট হয়, কিন্তু প্লাস্টিক থাকে শক্ত আর টেকসই।
শুরুতে প্লাস্টিক ব্যবহার সীমিত ছিল। কিন্তু শিল্পকারখানা বাড়তে থাকায়, মানুষের চাহিদা বাড়তে থাকায় প্লাস্টিকও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এখন এমন অবস্থা যে আমাদের খাবার, পোশাক, প্রযুক্তি—সবকিছুতেই প্লাস্টিক আছে।
প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এটা সহজে নষ্ট হয় না। একটি প্লাস্টিক ব্যাগ বা বোতল মাটির নিচে পচতে সময় নেয় শত থেকে হাজার বছর।
ফলে শহরের ড্রেন ভর্তি হচ্ছে পলিথিনে, গ্রামে খেলার মাঠে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে চিপসের প্যাকেট, সাগরে জমছে কোটি কোটি বোতল ও পলিথিন। চারপাশের পরিবেশ ধীরে ধীরে বিষাক্ত আবর্জনায় পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশের নদীগুলো, যেমন বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যা—সব নদী প্লাস্টিকের চাপে ভুগছে। বর্ষার সময় ড্রেন ভর্তি হয়ে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি করে।
সাগরে প্রতিবছর কোটি কোটি টন প্লাস্টিক জমে। সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ, ডলফিন, পাখি—এরা খাবার ভেবে প্লাস্টিক খেয়ে মরে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃতিও ধ্বংস হচ্ছে, মানুষের খাবারেও প্লাস্টিক ঢুকছে।
প্লাস্টিক ভেঙে তৈরি হয় অতি ক্ষুদ্র টুকরা, যাকে বলে মাইক্রোপ্লাস্টিক। আমরা পানি, খাবার—এমনকি বাতাসের সঙ্গে শরীরে নিচ্ছি।
গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের রক্ত, ফুসফুস—এমনকি গর্ভস্থ শিশুর শরীরেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি ক্যানসার, হৃদ্রোগ, শ্বাসকষ্ট ও হরমোনের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
যদি এভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার চলতে থাকে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের ওজন বেশি হবে।
সাগরে মাছের বদলে শুধু বোতল ও পলিথিন পাওয়া যাবে, জমিতে চাষ করা যাবে না, বাতাসে উড়বে অদৃশ্য কণা। তখন পৃথিবী হবে এক বিশাল আবর্জনার স্তূপ।
২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে বাজারে সহজেই পাওয়া যায় এই ব্যাগ। ঢাকা শহরে প্রতিদিন যত আবর্জনা তৈরি হয়, তার বড় একটা অংশই প্লাস্টিক। গ্রামেও এখন প্রতিটি দোকানে প্লাস্টিকের প্যাকেট ব্যবহার হয়। বছরে প্রায় ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, এর অর্ধেকের বেশি পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়।
প্লাস্টিকের সমস্যা দূর করতে হলে একবার ব্যবহার করা হয়, এমন প্লাস্টিক বাদ দিতে হবে।
কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প পদ্ধতিগুলোর প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে। রিসাইক্লিং বাড়াতে হবে।
জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। আইন কঠোরভাবে মানতে হবে। প্লাস্টিক পণ্য তৈরির উপকরণ ও যন্ত্র আমদানি বন্ধ করতে হবে।
প্লাস্টিক আমাদের জীবনের অংশ বটে, কিন্তু পৃথিবীর ভবিষ্যৎ তার চেয়ে বড়। এখনই সচেতন হলে আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য সবুজ ও সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে পারি।
আজই শপথ নিন—কম প্লাস্টিক ব্যবহার করব, বিকল্প ব্যবহার করব, পরিবেশ বাঁচাব। কারণ, সবুজ পৃথিবী গড়ার দায়িত্ব আমাদের সবার।
আরশী আক্তার সানী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা