
পৃথিবীর প্রায় সকল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষকতা একটি মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানজনক পেশা। শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের পাশাপাশি তাদের বেতনও উচ্চতর স্কেলে দেওয়া হয়। শিক্ষকেরা আর্থিক সুবিধা ছাড়াও রাষ্ট্র থেকে বিভিন্নরকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। সে হিসেবে আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদা এখনো সেইভাবে রাষ্ট্র দিতে পারেনি, এ জন্যই শিক্ষকেরা এখনো সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি। আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন সরকারের একজন গাড়ির ড্রাইভারের চাইতেও কম!
সব শ্রেণি পেশার মানুষ সুন্দরভাবে সমাজে চলতে পারলেও একজন প্রাথমিকের শিক্ষককে অনেক কষ্ট করে দিন/ মাস পার করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে সমাজে শিক্ষক ও তার পরিবার পারিপার্শ্বিকভাবে হেয় বা অবমূল্যায়িত হয়। তাই রাষ্ট্রকে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে একজন শিক্ষক যেন তার পরিবার পরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে সমাজে চলতে পারে। একজন শিক্ষক যদি মাসের বেতনের টাকায় ঠিকমতো চলতে না পারেন, তবে তিনি শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। প্রাথমিকের শিক্ষকদের দাবি প্রধান শিক্ষকদের মতো প্রস্তাবিত ১০ম গ্রেড সহকারী শিক্ষকদের প্রদান করা।
শিক্ষক সমাজ বিভিন্নভাবে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার বহুদিন থেকে। একজন শিক্ষক তার প্রাপ্য সম্মানটুকু যদি না পান তাহলে তিনি কীভাবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা দেবেন? সরকারকে শিক্ষকদের কল্যাণের জন্য দাবি পূরণে এগিয়ে আসতে হবে। একজন স্নাতক/মাস্টার্স ও ডি.পি.এড ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষক এখনো তৃতীয় শ্রেণির পর্যায়ের লোক হিসেবে গণ্য হবে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, একজন শিক্ষককে দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যমে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। যার চর্চা যত বেশি তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার তত বেশি পরিপূর্ণ হবে কিন্তু সে শিক্ষকের যদি চর্চা করার সুযোগ না থাকে তাহলে আদৌ ভালো শিক্ষক হিসেবে নিজেকে পরিণত করা সম্ভব হবে না। শিক্ষকতা পেশায় পদোন্নতি একবারেই নেই বললে চলে, এই কারণে শিক্ষকেরা কাজে কর্মে নিরাশ হয়ে পড়েন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ে পদোন্নতির সুযোগ না থাকে, তাহলে তার এই পেশার প্রতি একঘেঁয়েমি বা বিরক্তি চলে আসবে। যোগ্যতা অনুসারে পদোন্নতির সুযোগ রাখলে, তিনি তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাবেন। এতে কাজেও যেমন গতি আসবে এবং মনেও প্রশান্তি আসবে।
শিক্ষককে যদি সঠিক মান মর্যাদা দেওয়া না হয় তাহলে অযথা কেন তিনি কঠোর পরিশ্রম করে নিজের চিন্তাধারা বা সৃজনশীলতা প্রকাশ করবেন। একজন শিক্ষককে যদি প্রতি মুহূর্তে সংসারে অর্থের টানাপোড়েনের চিন্তা করতে হয় তাহলে তাঁর কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাও বোকামি।
একজন দায়িত্বশীল শিক্ষকই শিক্ষার্থী, সমাজ ও দেশকে পরিবর্তন করতে পারবেন। শিক্ষক তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে বদলে দেবেন বিদ্যালয়ের চেহারা। শিক্ষক সমাজের গুরু, পথ নির্দেশক, আলোকিত ব্যক্তি।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করতে হলে সবার আগে শিক্ষকদের চাহিদা পূরণ করতে হবে। শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মেধাবীদের এই পেশার প্রতি আকৃষ্ট করতে বা ধরে রাখতে হলে সকল ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষকদের দেশ-বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে, তাহলে তাঁরা নিজেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে পারবেন।
পরিশেষে, এ কথা বলতে চাই যে, শিক্ষকেরা আর দারিদ্র্যের খেতাব নিয়ে শিক্ষকতা করতে চান না, সমাজে অন্য দশজন ব্যক্তি যেভাবে উন্নত জীবন যাপন করে সেভাবে শিক্ষক সমাজও বাঁচতে চান। সরকার শিক্ষকদের ন্যায়সংগত দাবিগুলো বিবেচনায় এনে শিক্ষক সমাজকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাবেন এই কামনা করি।
গাজী আরিফ মান্নান
শিক্ষক
হাসানপুর, আনন্দ পুর
ফুলগাজী, ফেনী