প্রযুক্তি আসক্তি থেকে দূরে থাকুন।
প্রযুক্তি আসক্তি থেকে দূরে থাকুন।

চিঠিপত্র

ডিজিটাল আসক্তি: তরুণ প্রজন্মের হারিয়ে যাওয়া সময়

একটা সময় ছিল যখন রাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দে চিৎকার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে নানা রকম খেলায় মেতে থাকত ছোট শিশু থেকে শুরু করে অনেকেই। খেলায় মাঠ থেকে না ফেরার বায়না যেন তাদের নিত্যদিনের আবদার ছিল। সারা দিন খেলাধুলা, ঘরের বাইরে থাকার জন্য মায়ের হাতে মার না খেলে যেন পেটের ভাত হজমই হতো না।

‎কিন্তু ডিজিটাল সময়ের চাদরে হারিয়ে গেছে সেসব সময়। সেগুলো এখন রূপকথার গল্পের মতো গল্পেই সীমাবদ্ধ হতে শুরু করেছে। এখন রাতে বিদ্যুৎ গেলে ঘর থেকে বের হয় না কেউ, তবে রাত ২টা পর্যন্ত চোখ থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে। আগে বিদ্যুৎ চলে গেলে সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত, কিন্তু সময়ের স্রোতে তা বদলেছে। এখন বিদ্যুৎ চলে গেলে মন খারাপ হয়ে যায় তরুণদের। ওয়াইফাই না থাকার তীব্র বেদনায় তরুণদের মনে জমা হয় মন খারাপের কালো মেঘ। ডিজিটাল আসক্তির মায়ায় সে যেন তার মূল সত্তাকে হারিয়ে ফেলে।

‎এখন প্রশ্ন হলো ডিজিটাল আসক্তি তরুণদের কীভাবে ক্ষতি করছে? চলুন জেনে নেওয়া যাক এই মহামারি কীভাবে তরুণদের গিলে গিলে খাচ্ছে। আজকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তরুণ সমাজের জীবনে এক বড় অংশ হয়ে গেছে। পড়াশোনা, আড্ডা, বিনোদন, সবকিছুতেই এর ছাপ দেখা যায়। তবে ডিজিটাল বা সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তিতে অনেকেই পড়াশোনার সময়কে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে তারা ডিজিটাল ডিভাইসেই অধিকাংশ সময় মগ্ন থাকে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে, একাকিত্ব ও মানসিক চাপ বেড়েই চলেছে। তাই আজকের দিনে ডিজিটাল পারফর্ম শুধু সুবিধা নয়, তরুণদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‎ডিজিটাল আসক্তির সংখ্যা জরিপের মাধ্যমে জানা কঠিন, তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট আসক্তির হার অনেক বেশি। বিশ্বে স্মার্টফোনে আসক্ত প্রায় ২৬.৯৯ শতাংশ, তার মধ্যে ১৪.২২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট আসক্ত বলে সায়েন্সডিরেক্ট ডটকম দেখায়।

বাংলাদেশের আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি আসক্তি অনুভব করে। তবে বিশ্লেষকেরা এই জরিপের তত্ত্বের নির্ভরশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মধ্যে এই সংখ্যাটি অংশগ্রহণকারীর ধারণার ওপর ভিত্তি করে হতে পারে এবং বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।

তরুণদের ওপর পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, ৫৭ শতাংশ তরুণ নিয়মিত ‘FOMO’ বা মিস করার ভয়ে ভোগে। ৪১ শতাংশ বলেছে অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার তাদের মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ বাড়ায়। ইতিবাচক দিক হলো ২৮ শতাংশ তরুণ একবার ডিজিটাল ডিটেক্সের চেষ্টা করেছে, তবে বজায় রাখতে পেরেছে কেবল ১২ শতাংশ।

কারণ খুঁজতে গিয়ে এই ডিজিটাল আসক্তির পেছনে আমরা নানাবিধ জটিল কারণ খুঁজে পাই। যার মধ্যে অন্যতম হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এলগরিদম। একের পর এক পোস্ট, স্ট্যাটাস—যার কারণে তরুণেরা বুঝতেই পারে না কখন সময় চলে যাচ্ছে। আবার লাইক, কমেন্ট, শেয়ার এসবের মাধ্যমে তারা নিজেদের স্বীকৃতি খুঁজতে চায়। তার মধ্যে অনেকেই একাকিত্বে ভোগে, যার ফলে তারা ভার্চ্যুয়াল জগৎকে বেছে নেয়। সেখানে বন্ধু, বিনোদন, সবকিছু পায় ঠিকই, পাশাপাশি জীবনের অনেকটা মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যায়। আবার কে কী পোস্ট করছে? কার লাইক কত? এসব দেখে ডিজিটাল তরুণেরা অবস্থান মাপতে শুরু করেছে। যার ফলে তারা স্ক্রিনে আরও বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিভাবকেরা নিজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত, ফলে তাঁরা সন্তানকে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন না।

‎এই আসক্তি থেকে রেহাই পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? হ্যাঁ অবশ্যই, তবে একে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে কিছু উপায়ে এর প্রভাব কমানো যায়। প্রথমত, সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। যেমন ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় বরাদ্দ করা, তবে তার জন্য প্রয়োজন নিজের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তৈরি করা। প্রয়োজনে নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা। এর মধ্যে পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মা-বাবা কিংবা শিক্ষক তরুণদের ডিজিটাল ব্যবহারের সুস্থ নীতি তৈরি করতে পারেন।

আবার শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের চাপ কমানোর জন্য সময়সূচি পরিকল্পনা এবং সৃজনশীল খেলাধুলা চালু করা প্রয়োজন। খেলাধুলা, আড্ডা, বন্ধুদের সঙ্গে কার্যক্রম, এসব কিছু তরুণদের স্ক্রিনের আসক্তি থেকে মুক্ত করতে পারে।

‎সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, যেমন স্বাস্থ্য ও সময় ব্যবস্থাপনায় সাপোর্ট করা, হতে পারি স্ক্রিনের সীমা রিমাইন্ডার অথবা পচ ফিচার। সব মিলিয়ে তরুণদের মনস্তাত্ত্বিক শক্তি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থান, পারিবারিক সমর্থন সব মিলিয়ে ডিজিটাল আসক্তিমুক্ত তরুণ সমাজ গড়া সম্ভব।

ডিজিটাল আসক্তি কেবল একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের বড় একটি সংকট। এই সংকট থেকে মুক্ত হতে হলে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, পুরো সমাজকে সচেতন হতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তরুণদের ডিজিটাল ব্যবহারের নির্দেশনার পাশাপাশি অভিভাবকের উচিত নিজেদের আচরণকে মডেল হিসেবে দেখানো। তবেই তরুণেরা ফিরে পাবে একটি সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন। রাষ্ট্র ফিরে পাবে নতুন আশার আলো।

সানিয়া তাসনিম লামিয়া
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
‎ই–মেইল: lamiasaniatasnim@gmail.com