দিন যতই এগোচ্ছে, ততই বেড়ে যাচ্ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। যানবাহন বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানজট। এই যানজটে বসে থেকে প্রায় প্রতিদিনই দেখা মেলে এক ভিন্ন চিত্রের—৪ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত ভিক্ষা করছেন। এক বাস থেকে আরেক বাসে, এক গাড়ির জানালা থেকে অন্য গাড়ির জানালায় ঘুরে বেড়ানো ভিক্ষুকের সংখ্যা রাজধানীসহ দেশের নানা জায়গায় ক্রমেই বাড়ছে। কেউ অভাবের তাড়নায়, কেউবা এটিকে পেশা বানিয়ে নিয়েছে।
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, আয়ের পথ কমে যাওয়া ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে অন্তত আড়াই লাখ ভিক্ষুক আছে। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) বিভিন্ন জরিপে এ সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থানের সংকট ও ব্যবসায় লোকসান—এসব কারণে ভিক্ষাবৃত্তি বাড়ছে। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে ভিক্ষুকের সংখ্যা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। কর্মক্ষম অনেক মানুষই টিকে থাকার জন্য ভিক্ষার ঝুঁকিপূর্ণ পথে নামছে। ফলে প্রতিদিনই এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন মুখ। নগরজীবনে এটি নতুন সামাজিক সংকট তৈরি করছে।
বিবিএস বলছে, করোনার প্রভাবে শহর থেকে গ্রামে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় এতটাই বেড়েছে যে কোনো জরিপেই এখন প্রকৃত অবস্থা ধরা পড়ছে না। রাজধানীতে প্রতিদিন ভিক্ষা-বাণিজ্যে কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়। অথচ ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ থাকে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার কোটি টাকা। বিশ্লেষকদের মতে, এত অল্প অর্থ বরাদ্দ কার্যত হাস্যকর।
একদিকে যেমন অভাব-অনটনে বাধ্য হয়ে মানুষ ভিক্ষা করছে, অন্যদিকে এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী চক্র। পেশাদার ভিক্ষুকদের প্রতিরোধ করতে হবে।
একসময় ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হতো। এখন সেই অভিযান নেই। ফলে ভিক্ষুকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি শক্তিশালী হচ্ছে সিন্ডিকেটও। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডিকে ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা বলা হলেও বাস্তবে সেখানেই ভিক্ষুকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
গুলিস্তান, ফার্মগেট বা যাত্রাবাড়ীর তুলনায় এসব এলাকাতেই ভিক্ষুক বেশি দেখা যায়। রাস্তা, অলিগলি, বাজার, হাসপাতাল, শিক্ষাঙ্গন—সবখানেই এখন ভিক্ষুকের আনাগোনা। পঙ্গু, অন্ধ, খোঁড়া, বয়স্ক মানুষের পাশাপাশি অনেক শারীরিকভাবে সক্ষম মানুষও ভিক্ষা করছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের চার কোটি মানুষকে তাদের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে ঋণ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকে বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথে নামছে।
ভিক্ষাবৃত্তি নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক অনাচার ও বৈষম্যের প্রতীক। একদিকে যেমন অভাব-অনটনে বাধ্য হয়ে মানুষ ভিক্ষা করছে, অন্যদিকে এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী চক্র। পেশাদার ভিক্ষুকদের প্রতিরোধ করতে হবে। পাশাপাশি প্রকৃত অভাবীদের জন্য টেকসই আয়ের সুযোগ তৈরি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় উদ্যোগ অপরিহার্য।
মো. মুবাশ্বির হোসেন শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা