১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত মতামত বিভাগে সোহরাব হাসানের কলাম।
১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত মতামত বিভাগে সোহরাব হাসানের কলাম।

প্রতিক্রিয়া

একজন সরকারি কর্মচারী কি দিনমজুরের চেয়ে খারাপ জীবন যাপন করবে

১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত মতামত বিভাগে সোহরাব হাসানের ‘তাঁরা পাবেন মহার্ঘ ভাতা, অন্যরা কি টিসিবি ট্রাকের লাইনে দাঁড়াবে’ শীর্ষক লেখাটি পড়ে আমার মতো লাখ লাখ ১০-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারী ভীষণ মর্মাহত।

১৯৭৩ সালের প্রথম পে-স্কেল থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের পে-স্কেল পর্যন্ত সব পে-স্কেলেই বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির নিয়ম চালু ছিল। তবে তা ছিল একটি নির্দিষ্ট হারে (যেমন ১৯৭৩–এ বাৎসরিক ৫-৬-৮-১৫-২৫-৩৫-৪৫-৬০-৭০ টাকা হারে। আবার ২০০৯–এ বাৎসরিক ১৯০-২১০-২২০-২৪০-২৬৫... টাকা হারে।) পূর্বের পে-স্কেলে কেউ বেতনক্রমের সর্বশেষ ধাপে পৌঁছালে পরবর্তী বছর উচ্চতর বেতনক্রমে মূল বেতন নির্ধারণ হতো। একই পদে ৮-১২-১৫ বছর চাকরি করলে টাইম স্কেল পাওয়া যেত। এতে সেসব পদে দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত থাকলেও আর্থিক সুবিধা পাওয়া যেত।

কিন্তু ২০১৫ সালে পে-স্কেলে সাময়িকভাবে বেতন দ্বিগুণ হলেও দীর্ঘমেয়াদে ১০-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীরা মারাত্মকভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এখন প্রতিবছর বেতন বৃদ্ধি ৫ শতাংশ হারে হয়। ২০১৫–পরবর্তী বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার সবচেয়ে ভালো জানার কথা প্রথম আলো পত্রিকার। সেই সঙ্গে ডিজেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম কতবার কত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটাও বিবেচনায় নেবেন।

১০-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীরা চাকরিজীবনে একটি পদোন্নতি পেতে ক্ষেত্রবিশেষে ১৫-২০-২৫ বছর সময় অতিবাহিত হয় (সচিবালয়ে কর্মরত কর্মচারী ব্যতীত)। ২০১৫ সালে পে-স্কেলে ৮-১২-১৫ বছরে চাকরি করলে টাইম স্কেল সুবিধা নেই। আছে ২টি উচ্চতর গ্রেড যা ১০-১৬ বছর একই পদে চাকরি করলে পাওয়া যায়। আবার ২০১৫ সালে পে-স্কেলে কেউ বেতনক্রমের সর্বশেষ ধাপে পৌঁছালে তাঁর মূল বেতন আর বৃদ্ধি পায় না। যদি তাঁর আর পদোন্নতি না হয়, তাহলে তাঁকে বছরের পর বছর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হতে হবে।

এমন অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী আছেন, যাঁরা ৫-৬ বছর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয়ে অবসরে গেছেন। অথচ সন্তোষজনক চাকরিরত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন, এটা চাকরির বিধি। যদি না কারও বিরুদ্ধে কোনো শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ থাকে বা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বন্ধের শাস্তি আরোপ থাকে। কেবল ২০১৫ সালের পে-স্কেলের একটি ধারার কারণে সন্তোষজনক চাকরি করেও বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি পায় না। এতে চাকরিজীবনের শেষ দিকে বেতন ও পেনশন নির্ধারণে অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়।

বাজারের সঙ্গে মিল রেখে বেতন নির্ধারণ করুক আর কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি পেলে কঠিন থেকে কঠিনতর সাজা দিক। কিন্তু কম বেতনে চাকরি করার কথা বলার মানে হচ্ছে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা। আমরা কোনো বেনজীর-মতিউর-আবিদ-মালেক হতে চাই না। আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে পরিবার নিয়ে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে চাই। বছরে মাথাপিছু ২ হাজার ৭৮৪ ডলারের সমপরিমাণ টাকা ২০ গ্রেডের একজন কর্মচারীর আয় হতে হবে।

২০১৫ সালে ৮ হাজার ২০০ টাকা মূল বেতনে চাকরি শুরু করা একজন নিম্ন পদের কর্মচারী মাসে সব মিলিয়ে ১৫ হাজার ৩০০ টাকা বেতন পান। সেই একই কর্মচারী ২০২৪ সালে ১২ হাজার ২৪০ টাকা মূল বেতনে মাসে সব মিলিয়ে এখন ২১ হাজার টাকা বেতন পান। এ হিসাব আবার ঢাকার বাইরে আরও কম। এর ভেতর প্রায় ১০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ে বাজারমূল্য, ডিজেল, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির তুলনা করলে এই কর্মচারীর বেতন কমে গেছে।

এখন একজন সিএনজিচালক, রাজমিস্ত্রি, হেলপারও মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। একজন ২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারী কি সিএনজিচালক, রাজমিস্ত্রি, হেলপার, দিনমজুরের চেয়ে খারাপ জীবন যাপন করবে? তাহলে রাষ্ট্রের এই পদে কে চাকরি করতে আসবেন? বেনজীর আহমেদ, মতিউর রহমানরা তো সব সরকারি কর্মচারীর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাঁরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে দুর্নীতি করে গেছেন। রাষ্ট্র কি চায় কম বেতনের চাকরিজীবীরা দুর্নীতির মাধ্যমে জীবন যাপন করুক? বিনা সুদের গাড়ি কি একজন ১০-২০ গ্রেডের কর্মচারী পান? তাঁর কি পরিবার নিয়ে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করার অধিকার নেই?

বাজারের সঙ্গে মিল রেখে বেতন নির্ধারণ করুক আর কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি পেলে কঠিন থেকে কঠিনতর সাজা দিক। কিন্তু কম বেতনে চাকরি করার কথা বলার মানে হচ্ছে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা। আমরা কোনো বেনজীর-মতিউর-আবিদ-মালেক হতে চাই না। আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে পরিবার নিয়ে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে চাই। বছরে মাথাপিছু ২ হাজার ৭৮৪ ডলারের সমপরিমাণ টাকা ২০ গ্রেডের একজন কর্মচারীর আয় হতে হবে।

সাধারণ মানুষ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। তাঁরা ইচ্ছা করলেই মুদ্রাস্ফীতির চাপ সামলাতে পারেন। যেমন সিএনজিচালক কিছুদিন পরপর ভাড়া বাড়ান, রাজমিস্ত্রি মজুরি বাড়ান, তৈরি পোশাকশিল্পেও মজুরি বাড়ে, ব্যাংকে ভালো বেতনের পাশাপাশি দৈনিক টিফিন ভাতাও পাওয়া যায়...ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের মতো সরকারি চাকরিজীবীদের নীরব কান্না ছাড়া কিছুই নেই।

নিয়ম অনুযায়ী ২০২০/২১ সালেই আমাদের পে–স্কেল দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কদিন পরই ২০২৫ সাল। পে–স্কেল নেই। মুদ্রাস্ফীতির চাপ সামলাতে সব রকম পরিবেশ–পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার কথা জানায়। অনেক সরকারি চাকরিজীবী মুখে রুমাল বেঁধে টিসিবির গাড়ি থেকে পণ্য কেনেন। সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২৫০ টাকা মূল বেতনে সর্বসাকল্যে ১৫ হাজার টাকা আসে। এই ১৫ হাজার টাকা দিয়ে কেমন করে একটা পরিবার চলে!

যদি রাষ্ট্র বাজারমূল্য, ডিজেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম ২০১৫ সালের মতো করে দিতে পারে, তবে ১০-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীরা নতুন পে-স্কেল বা মহার্ঘ ভাতা বা অন্য কিছুই চাইবেন না।

মো. সালাহ উদ্দিন

১০-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীদের একজন