‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার কোথায়’ শীর্ষক সম্মেলনটি আয়োজন করে নাগরিক সংগঠন ‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম’। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন। ৯ অক্টোবর
‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার কোথায়’ শীর্ষক সম্মেলনটি আয়োজন করে নাগরিক সংগঠন ‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম’। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন। ৯ অক্টোবর

আগামী নির্বাচনেই সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোট চান উপদেষ্টা ফরিদা

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচন করা উচিত বলে মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।

এই উপদেষ্টা বলেন, ‘সংরক্ষিত নারী আসনে এখন আমরা যে দাবিগুলো করছি…এটাকে সরাসরি নির্বাচনে আনার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা এই নির্বাচনেই করতে হবে। আমরা এটা যদি পরবর্তী, আমাদেরকে যদি বলে যে পরের সংসদে এটা ঠিক হবে…এই ভাঁওতাবাজিতে আমরা যেতে চাই না।’

জাতীয় রাজনীতিতে নারীর অর্থপূর্ণ প্রতিনিধিত্বের দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। ‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার কোথায়’ শীর্ষক সম্মেলনটি আয়োজন করে নাগরিক সংগঠন ‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম’।

উপদেষ্টা ফরিদা বলেন, সংরক্ষিত নারী আসন রাখার মূল উদ্দেশ্য সাধারণ আসনগুলোতে ধীরে ধীরে নারীদের ৫০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক দলগুলোকে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে মত দিতে হবে। তা না হলে নারীরা ভোটে জবাব দেবেন। তিনি আরও বলেন, যাঁরা বলেন নারীদের মনোনয়ন দিলে তাঁরা জিততে পারবেন কি না, তাঁরা সুমুদ ফ্লোটিলার দিকে তাকান। সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন নারী।

নারীরা অর্থের কারণে নির্বাচনে যেতে ভয় পান—এমনটি মনে করেন সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। নারীদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্বাচনী ব্যয় বহনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নারী প্রার্থীর ব্যয় যদি রাষ্ট্র দেয়, তাহলে নারী প্রার্থীদের আর্থিক জায়গাটা শক্তিশালী হবে এবং অনেক নারী নির্বাচনে অংশ নেবেন। এর মধ্য দিয়েই রাজনীতিতে পুরুষতান্ত্রিক বলয় ভাঙা শুরু করতে হবে। এ সময় উপস্থিত নারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচনটা কিন্তু বাদ দেওয়া যাবে না। মেয়েরা, এই নির্বাচনটা বাদ দেওয়া যাবে না।’

সম্মেলনে শুরুতে সভাপতির বক্তব্য দেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট। ৯ অক্টোবর

সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা বলেন, দলগুলো নারীদের মনোনয়ন দেবে কি না, সেই আলোচনা বিতর্ক চলতে থাকবে। পাশাপাশি নারী সংগঠনগুলো চাইলে স্বতন্ত্র নারী প্রার্থীদের সহযোগিতা করতে পারে। যেন তাঁরা আগামী নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে জিততে পারেন।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে। তিনি বলেন, শুধু নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেই হবে না, তাঁদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা হলে সেখানেও নারীদের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।

জামায়াতে ৪৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, নারী প্রার্থীদের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি সমর্থন এবং সহকর্মীদের সহযোগিতা প্রয়োজন। সেই জায়গায় দেশ এখনো পৌঁছাতে পারেনি।

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক তাসনুভা জাবিন বলেন, সংরক্ষিত আসনের অভিশাপ থেকে নারীদের মুক্ত করতে, নারীদের সক্রিয় করতে, রাজনীতিকে নারীদের অংশগ্রহণকে স্বাভাবিকভাবে দেখার বিষয়ে অনেক আগে থেকে আলোচনা হয়ে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এটা রাখলেও আজ পর্যন্ত এটা কার্যকর হয়নি।

নারীদের মূল্যায়নের দিক থেকে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নারী কর্মীদের মধ্যে হতাশা থাকলেও জামায়াতে ইসলামী এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলে সম্মেলনে দাবি করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীরমহিলা বিভাগের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য হাবিবা আক্তার চৌধুরী। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটি, মজলিশে শুরায় ৪৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। জামায়াত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী চায় নারীরা তাঁদের যোগ্যতাকে কাজে লাগাক।

বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন। ৯ অক্টোবর

নারীর জন্য প্রতিকূল রাজনীতি

দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ নারীদের জন্য ভয়ংকর প্রতিকূল বলে মন্তব্য করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ফেসবুকে গেলে বোঝা যায় নারীদের কী পরিমাণ বুলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা থাকতে হবে উল্লেখ করে জোনায়েদ সাকি বলেন, ফেসবুকে সমর্থকদের আচরণ বিষয়ে দলগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। নারীদের জন্য রাজনীতিতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নারীদের হয়রানি করা বা রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিষদ এখন পর্যন্ত নারীদের মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। অথচ সেই মানসিকতা থাকা দরকার ছিল। এ জন্য আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার।

ঘোষণাপত্র

সম্মেলনের শুরুতে নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরামের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এতে বলা হয়, রাজনৈতিক দলের মনোনয়নপ্রক্রিয়ায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় কাঠামোর প্রতিটি স্তরে নারীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি নারীর যথাযোগ্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশেষ বন্দোবস্ত হিসেবে সংরক্ষিত ১০০ আসনে নারীদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং আরপিও সংশোধন করে ধাপে ধাপে তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।

সম্মেলনে শুরুতে সভাপতিত্ব করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের রাজনীতিতে, আমাদের সংসদে নতুন নেতৃত্ব আনার ব্যবস্থা হোক।’ এরপর তিনি নারীপক্ষের সভানেত্রী গীতা দাসকে সভাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে অনুষ্ঠান ত্যাগ করেন।

সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহীন সুলতানা, বিএনপি নেত্রী নিলোফার চৌধুরী, এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, এবি পার্টির নারীবিষয়ক সম্পাদক ফারাহ নাজ সাত্তার, ডাকসু প্রতিনিধি হেমা চাকমা প্রমুখ। সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন তাসলিমা আখতার ও মাহরুখ মহিউদ্দীন।