
ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রার শাড়ি নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে মারামারিতে জড়িয়েছিল দুটি পক্ষ। এ ঘটনায় এক পক্ষের তিন নেত্রীসহ চারজন আহত হন। অবশ্য পরে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের হস্তক্ষেপে ঘটনাটির মীমাংসা হয়।
শাড়ি নিয়ে বিবাদ থেকে সংগঠনের হল শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে না গিয়ে এক নেত্রী নিজের অনুসারীদের নিয়ে আলাদাভাবে কর্মসূচিতে যান। এরপরেই মারামারি হয়।
গতকাল শুক্রবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল প্রাঙ্গণে এ ঘটনা ঘটে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য থাকা পাঁচটি হলের একটি।
ঘটনার পরপরই বঙ্গমাতা হলে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী। পরে সেখানে গিয়ে বিবদমান দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন হলটির প্রাধ্যক্ষ নিলুফার পারভীনও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের হল কমিটি হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে। ১৮টি হলের ৩৬টি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ তখন ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছিল।
কিন্তু গত ২০ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নতুন কমিটি ঘোষণার পর পাল্টে গেছে প্রেক্ষাপট। নতুন চার শীর্ষ নেতাকে (কেন্দ্রীয় দুই নেতা সাদ্দাম হোসেন ও শেখ ওয়ালী আসিফ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা মাজহারুল কবির ও তানভীর হাসান) ঘিরে অঞ্চলভিত্তিক নতুন পক্ষ তৈরি হওয়ায় হল শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের কর্তৃত্ব এখন শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু কিছু হলে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকেরা কর্তৃত্ব ছাড়তে চাইছেন না। বঙ্গমাতা হলে হাতাহাতির ঘটনাটির পেছনেও একই কারণ কাজ করেছে।
বঙ্গমাতা হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও সাধারণ ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে হল শাখা ছাত্রলীগের কমিটি হওয়ার আগপর্যন্ত এই হলের সভাপতি ছিলেন বেনজীর হোসেন (পরে কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন), সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রনক জাহান (পরে কেন্দ্রীয় উপসম্পাদক হন)।
ফেব্রুয়ারিতে এই হল শাখার সভাপতি হওয়া কোহিনূর আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক হওয়া সানজিনা ইয়াসমিন ছিলেন বেনজীরের অনুসারী৷ রনকের অনুসারী পক্ষটি তখন থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেত্রী তানিয়া আক্তারের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে থাকে৷ তানিয়া বঙ্গমাতা হল শাখার শীর্ষ পদপ্রত্যাশী ছিলেন৷ কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই পদ না পেলেও পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপসম্পাদক হন৷ ২০ ডিসেম্বর নতুন কমিটি হওয়ার পর থেকে তানিয়ার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসানকে অনুসরণ করা শুরু করে রনকের অনুসারী পক্ষটি৷
বঙ্গমাতা হল সূত্র জানায়, গতকাল শুক্রবার ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রা উপলক্ষে অন্য ছাত্রী হলগুলোর মতো বঙ্গমাতা হলেও নেতা-কর্মীদের জন্য একই রঙের শাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তানিয়া তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীদের জন্য শাড়ি চাইলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কোহিনূর ও সাধারণ সম্পাদক সানজিনা। তানিয়া বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসানকে জানালে তিনি তাঁদের সাধারণ পোশাকেই শোভাযাত্রায় যাওয়ার পরামর্শ দেন।
তানিয়া কোহিনূর ও সানজিনার নেতৃত্বে না গিয়ে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে আলাদাভাবে সাধারণ পোশাকে শোভাযাত্রার কর্মসূচিতে অংশ নেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোহিনূর ও সানজিনার অনুসারীরা তানিয়াকে হলছাড়া করার হুমকি দেন। শোভাযাত্রা শেষে সন্ধ্যার পর হলে গেলে রনক জাহান, তানিয়া ও তাঁদের অনুসারীদের সঙ্গে কোহিনূর-সানজিনা ও তাঁদের অনুসারীদের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তা মারামারিতে রূপ নেয়৷
কোহিনূর-সানজিনা ও তাঁদের অনুসারীদের মারধরে আহত হন বঙ্গমাতা হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পরে কেন্দ্রীয় উপসম্পাদক হওয়া রনক জাহান, সদ্য সাবেক কেন্দ্রীয় উপসম্পাদক তানিয়া আক্তার ও রনকের অনুসারী সুলতানা।
এ সময় খাবার খাওয়ার জন্য নিচে নামা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাহিদা আক্তারকে তানিয়ার অনুসারী ভেবে মারধর করেন কোহিনূর-সানজিনার অনুসারীরা। যদিও শাহিদা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। আহত চারজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রাতেই হলে ফিরেছেন।
এ ঘটনার পরপরই বঙ্গমাতা হলে গিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গমাতা হলের ছাত্রীদের দুটি পক্ষের মধ্যে একধরনের অবস্থান তৈরি হয়েছিল। এটা খুব বড় কোনো বিষয় ছিল না। আমরা দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। পরে দুই পক্ষই বিষয়টি মেনে নেয় এবং ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর আমি ওই হল থেকে চলে আসি।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান বলেন, ‘বঙ্গমাতা হলে যা ঘটেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা কাম্য নয়। সাধারণ শিক্ষার্থী হোক বা ছাত্রলীগের কর্মী, কারওই এ ধরনের ঘটনায় জড়িত থাকা উচিত নয়। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আমাদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রাধ্যক্ষসহ দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান করা হয়েছে।’
গতকালের এ ঘটনার বিষয়ে জানতে হল প্রাধ্যক্ষ নিলুফার পারভীনের মুঠোফোনে একাধিক কল করেও সাড়া মেলেনি। আহত রনক জাহান ও তানিয়া আক্তারের মুঠোফোনে একাধিক কল করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি। মারধরে অভিযুক্ত বঙ্গমাতা হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কোহিনূর ও সাধারণ সম্পাদক সানজিনাও ফোন ধরেননি।
২০২০ সালেও ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনের শাড়িকে কেন্দ্র করে বঙ্গমাতা হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ মারামারিতে জড়িয়েছিল। তখন হল শাখা ছাত্রলীগের একটি পক্ষের নেতা-কর্মীদের পিটিয়েছিলেন রনক জাহানের অনুসারীরা।