
ইসলাম সব মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। ইসলাম কখনোই অনর্থক দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে সমর্থন করে না। তাই শান্তির দূত রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের মুসলমান, ইহুদি, পৌত্তলিকসহ নানা ধর্মের ও নানা বর্ণের লোকদের নিয়ে একটি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন, যা জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ইতিহাসে এটি মদিনা সনদ নামে পরিচিত। এটি একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। এ চুক্তির নানামুখী উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ছিল যুদ্ধের পরিবর্তে পরস্পরের শান্তিপূর্ণ অবস্থান। এ চুক্তির আরও উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারিত-নিপীড়িতকে সাহায্য করা এবং চুক্তিভুক্ত সব পক্ষের মান-মর্যাদা ও ধর্মবিশ্বাসের অধিকার সংরক্ষণ করা। ইসলাম যে শান্তি চায়, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো এই মদিনা সনদ।
‘মদিনা সনদ’ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন সাধন করে। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নৈরাজ্য, সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে যুদ্ধবাজ গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘাতের পরিবর্তে গড়ে তোলে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন।
মদিনা সনদে সর্বমোট ৬১টি ধারা-উপধারা রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো ছিল এ রকম:
কুরাইশ ও ইয়াসরিবের(মাদিনা) মুমিন মুসলিমরা ও যারা তাদের অনুগামী হয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং তাদের সঙ্গে মিলে দেশের প্রতিরক্ষা করবে, তাদের মধ্যে তারা অভিন্ন একটি জাতি বলে পরিগণিত হবে। কুরাইশদের মধ্য থেকে যারা মুহাজির, তারা তাদের পূর্বাবস্থায় বহাল থাকবে; তারা মুমিনদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করবে। বনু আওফ, বনু হারেস (বনু খাযরাজ), বনু সায়েদাহ, বনু জুশাম, বনু নাজ্জার, বনু আমর ইবন আওফ, বনু নাবিত, বনু আওস—সবাই তাদের মধ্যে বিদ্যমান পূর্ব দায় আদায় করবে এবং সব সম্প্রদায় নিজ নিজ পণ স্বেচ্ছায় প্রদান করবে এবং মুমিনদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করবে।
মুমিনরা তাদের কাউকে দায়গ্রস্ত ফেলে রাখবে না, বরং তাদের মুক্তিপণ বা রক্তপণ স্বেচ্ছাদানে আদায় করে দেবে। কোনো মুমিন অন্য মুমিনের অনুমতি ছাড়া তার বন্ধুর সঙ্গে মিত্রতা করবে না। মুমিন মুত্তাকিদের কারও ওপর কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে অথবা জুলুমের থাবা বিস্তার করতে চাইলে অথবা কোনো অন্যায় বা সীমা লঙ্ঘন করতে চাইলে অথবা মুমিনদের মধ্যে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইলে সবাই সম্মিলিতভাবে তার প্রতিকার করবে, যদি সে তাদের কারও সন্তানও হয়।
কোনো মুমিন কারও পক্ষ নিয়ে অন্য কাউকে হত্যা করবে না এবং কোনো মুমিনের বিপক্ষে কাউকে সাহায্য করবে না। আল্লাহর নিরাপত্তা জিম্মাদারি সবার জন্য একই সমান, একজন সাধারণ লোকও যে কাউকে নিরাপত্তা আশ্রয় দিতে পারবে। মুমিনরা স্বতন্ত্রভাবে পরস্পরের মিত্র। তবে ইহুদিদের মধ্যে যারা এই চুক্তির অনুগামী হবে, তাদের জন্য সাহায্য ও মর্যাদার অধিকার থাকবে। যুদ্ধ অবস্থায় ইহুদিরাও মুমিনদের সঙ্গে ব্যয়ভার বহন করবে। তাদের প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করা হবে না।
মুমিনদের প্রদত্ত শান্তি ও নিরাপত্তা হবে অভিন্ন, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের সময় এক মুমিনকে ছেড়ে অন্য মুমিন নিরাপত্তা চুক্তি করতে পারবে না, বরং পারস্পরিক সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক চুক্তিই গৃহীত হবে। রক্তপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে মুমিনরা একে অন্যের পক্ষে তা প্রতিহত করবে। নিশ্চয়ই ধর্মনিষ্ঠ মুমিনরা উত্তম ও সুষ্ঠুতম হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কোনো মুমিন, যে এই চুক্তিপত্রে বিদ্যমান বিষয় স্বীকার করে নিয়েছে এবং আল্লাহ ও আখিরাতে ইমান এনেছে, তার জন্য কোনো চুক্তি ভঙ্গকারীকে সাহায্য করা বা আশ্রয় দেওয়া বৈধ নয়। যে এমন কাউকে সাহায্য করবে অথবা আশ্রয় দেবে, তার ওপর রোজ কিয়ামতে আল্লাহর লানত ও ক্রোধ নিপতিত হবে। সেদিন তার কাছ থেকে টাকাপয়সা গ্রহণ করা হবে না।
বনু আওফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই জাতি হিসেবে গণ্য হবে: ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম। বনু নাজ্জার, বনু হারেস, বনু সায়েদাহ, বনু জুশাম, বনু আওস, বনু সালাবাহ—সব গোত্রের ইহুদিরা বনু আওফের অনুরূপ অধিকার পাবে। তারা এবং তাদের মিত্ররা অভিন্ন অবস্থানে থাকবে। তবে যে জুলুম করবে এবং অপরাধে লিপ্ত হবে, সে বস্তুত নিজেকে ও নিজ পরিজনকেই ধ্বংস করবে। বনু সালাবাহ গোত্রের উপগোত্র জুফনা সালাবাহের মতোই গণ্য হবে। বনু শুতাইবাহের জন্য আওফের অনুরূপ অধিকার থাকবে। অবশ্যই অঙ্গীকার পূর্ণ করতে হবে, তা ভঙ্গ করা যাবে না; এবং সালাবাহ গোত্রের মিত্ররা তাদেরই মতো। নিশ্চয়ই ইহুদিদের আন্তরিক মিত্ররা তাদেরই মতো গণ্য হবে।
অধিকারবঞ্চিত ব্যক্তিকে প্রাপ্য গ্রহণে বাধা দেওয়া যাবে না। যে ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করবে, সে ও সেই-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জন্য দায়ী হবে। তবে যদি কেউ মজলুম হয়, তাহলে সে নিজের প্রতিরক্ষা করতে পারবে। এই চুক্তিপত্রের পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে কেউ লড়াই করলে পক্ষগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তা প্রতিহত করবে। এবং পক্ষগুলোর নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও কল্যাণকামিতা বজায় রাখবে। প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে, তা ভঙ্গ করবে না। কোনো ব্যক্তি তার মিত্রের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না এবং মজলুমকে সবাই সাহায্য করবে। যুদ্ধ অবস্থায় ইহুদিরাও মুমিনদের সঙ্গে ব্যয়ভার বহন করবে। ইহুদিদের ব্যয়ভার তারা বহন করবে এবং মুসলিমরা তাদের ব্যয়ভার বহন করবে।
এই চুক্তির পক্ষগুলোর জন্য ইয়াসরিব (মদিনা) একটি সংরক্ষিত ও পবিত্র নগরী হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রতিবেশীকে নিজের মতোই গণ্য করতে হবে। তার কোনো ÿক্ষতি বা তার প্রতি কোনো অপরাধ সংঘটন করা যাবে না। কোনো নারীকে তার পরিবারের অনুমতি ছাড়া আশ্রয় দেওয়া যাবে না। (মদিনার প্রতিপক্ষ মক্কার) কুরাইশ ও তাদের সাহায্যকারীদের কোনো আশ্রয় দেওয়া যাবে না। ইয়াসরিবকে (মদিনা) কেউ আক্রমণ করলে চুক্তির সব পক্ষ পারস্পরিক সাহায্যের মাধ্যমে তা প্রতিহত করবে। যখন তাদের সঙ্গে ইহুদিদের কোনো সন্ধি করতে এবং সংশ্লিষ্ট হতে আহ্বান করা হবে, তারা সেই সন্ধি করবে এবং দায়ভার গ্রহণ করবে। যদি তারা অনুরূপ সন্ধির পক্ষে যায়, তখন মুমিনের ওপরও তাদের দাবি আছে। তবে যদি ইহুদিরা ধর্মকে আঘাতকারী কারও সঙ্গে সন্ধি করতে চায়, তা মুমিনরা মেনে নেবে না।
আওস গোত্রীয় ইহুদি তাদের মিত্ররা এবং তাদের নিজেদের এই চুক্তিপত্রের পক্ষগুলোর অনুরূপ গণ্য করা হবে। এই চুক্তিপত্রের পক্ষগুলো থেকে তারা বিশ্বস্ত ও কল্যাণকামী আচরণ পাবে। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার রক্ষা করতে হবে, ভঙ্গ করা যাবে না। কেউ কোনো বিরূপ কর্মতৎপরতায় জড়িত হলে তা তার ওপরই বর্তাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ এই চুক্তিপত্রের বিষয়াদির সত্যনিষ্ঠ বাস্তবায়ন ও প্রতিশ্রুতির প্রতিপালনকারীদের সঙ্গে আছেন।
এই সনদ কোনো জালেম বা অপরাধীকে রক্ষা করবে না। মদিনা থেকে যে বাইরে যাবে, সে নিরাপদ এবং যে এর অভ্যন্তরে অবস্থান করবে, সে–ও নিরাপদ। তবে যে জুলুম করবে এবং অপরাধ করবে, সে নয়। যে ব্যক্তি এই চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে, আল্লাহ তার সাহায্য করবেন। এই চুক্তিপত্রের উত্তম হেফাজতকারী ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারীর ওপর আল্লাহ (সাক্ষী) আছেন। চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর কেউ হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হতে পারবে না। কোনো বিষয়ে যখনই মতানৈক্য হবে, তখন তা আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর সমীপে সোপর্দ করতে হবে।
শান্তির জন্য চাই সত্যনিষ্ঠা ও সংযম। তাই মদিনা সনদের সর্বশেষে লেখা হয়: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.) সে ব্যক্তির সাহায্যকারী, যে সত্যনিষ্ঠ ও সংযত।’ (সীরাতুন নবী, ইবনে হিশাম)।
প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ না করে সন্ধিতে আবদ্ধ হওয়া মহানবী (সা.)–এর শান্তিকামিতার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি শান্তি স্থাপনের জন্য হুদাইবিয়ার সন্ধি ছাড়াও আরও বহু সন্ধিতে আবদ্ধ হয়েছেন। বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা জীবন এই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর কাজের মূলনীতিসমূহের প্রথম মূলনীতি ছিল সব ধরনের অশান্তি ও অরাজকতা দূর করা।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail