বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব
বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব

বুদ্ধপূর্ণিমা:

গৌতম বুদ্ধের সৌন্দর্যমণ্ডিত উৎসব

বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব, যা বৈশাখ মাসের পূর্ণিমাতিথিতে বিশ্বজুড়ে উদ্‌যাপিত হয়। দিনটি গৌতম বুদ্ধের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়—তাঁর জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ। এই তিন ঐতিহাসিক ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমায় সংঘটিত হওয়ায় দিনটি ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’ নামে খ্যাত। বৌদ্ধ পরিভাষায় বৈশাখী পূর্ণিমাকে বুদ্ধপূর্ণিমা বলা হয়, যা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে এই শুভ তিথিতে কপিলবাস্তুর লুম্বিনীতে রাজা শুদ্ধোধন ও রানি মহামায়ার পুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন সন্তানহীন থাকার পর তাঁদের কোল আলোকিত করে এই শিশুর জন্ম হয়। পিতা শুদ্ধোধন তাঁর নাম রাখেন সিদ্ধার্থ, যার অর্থ ‘ইচ্ছাসিদ্ধি’। এই সিদ্ধার্থই পরবর্তী সময় ‘গৌতম বুদ্ধ’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হন। ‘বুদ্ধ’ শব্দের অর্থ পরমজ্ঞানী, যিনি জীবনের সত্যকে উপলব্ধি করে মানবজাতির কল্যাণে তাঁর জ্ঞান প্রচার করেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে, ৩৫ বছর বয়সে, সিদ্ধার্থ গৌতম বৈশাখী পূর্ণিমার এই দিনে বোধগয়ায় একটি অশ্বত্থগাছের নিচে গভীর ধ্যান ও সাধনার মাধ্যমে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। এ ঘটনা তাঁকে ‘বুদ্ধ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর এই আধ্যাত্মিক জাগরণের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন হয়। বুদ্ধ তাঁর শিক্ষায় মধ্যমার্গের পথ প্রচার করেন, যা জীবনের চরম আত্মত্যাগ ও অতিরিক্ত ভোগবিলাসের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের পথ। তিনি এই মধ্যমার্গকে অষ্টাঙ্গিক মার্গ হিসেবে বর্ণনা করেন, যা আটটি নীতির সমন্বয়ে গঠিত। এগুলো হলো—সৎ দর্শন (সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি), সৎ সংকল্প (সঠিক উদ্দেশ্য), সৎ বাক্য (সঠিক কথা), সৎ ব্যবহার (সঠিক আচরণ), সৎ জীবনযাপন (সঠিক জীবিকা), সৎ চেষ্টা (সঠিক প্রচেষ্টা), সৎ চিন্তা (সঠিক মনন) ও সম্যক সমাধি (সঠিক ধ্যান)। এই অষ্টাঙ্গিক মার্গ বৌদ্ধধর্মের মূল ভিত্তি এবং মানুষকে দুঃখ থেকে মুক্তির পথ দেখায়।

বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব

পরবর্তীকালে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে, ৮০ বছর বয়সে গৌতম বুদ্ধ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় কুশিনগরে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন, অর্থাৎ দেহত্যাগ করেন। তাঁর এই মহাপরিনির্বাণ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জন্য গভীর তাৎপর্য বহন করে। এটি বুদ্ধের শারীরিক জীবনের সমাপ্তি হলেও তাঁর শিক্ষা ও দর্শন চিরন্তন হয়ে থাকে। তাঁর শিক্ষা বিশ্বজুড়ে শান্তি, অহিংসা ও করুণার বাণী ছড়িয়ে দিয়েছে।

বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত পবিত্র দিন। এই দিনে বৌদ্ধরা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বৌদ্ধবিহারগুলোতে পূজা, পঞ্চশীল ও অষ্টশীল পালন, সূত্র পাঠ, সূত্র শ্রবণ ও সমবেত প্রার্থনার মতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। পঞ্চশীল হলো পাঁচটি নৈতিক নীতি, যা বৌদ্ধরা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে পালন করেন। এগুলো হলো—হিংসা না করা, চুরি না করা, মিথ্যা না বলা, মাদক গ্রহণ না করা ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকা। অষ্টশীল হলো আরও উচ্চতর নৈতিক নীতি, যা বিশেষ দিনে পালন করা হয়, যেমন বুদ্ধপূর্ণিমার মতো পবিত্র দিনে।

বৌদ্ধবিহারগুলোতে এই দিনে বুদ্ধের জীবন, তাঁর শিক্ষা ও বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এই আলোচনা সভাগুলোতে বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন দিক, তাঁর ত্যাগ, সাধনা ও মানবকল্যাণে তাঁর অবদান তুলে ধরা হয়। অনেক বৌদ্ধবিহারে তিন দিনব্যাপী নানামুখী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, আলোকসজ্জা, ধ্যান ও দানের মতো কার্যক্রম। দান করা বৌদ্ধধর্মে একটি মহৎ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই দিনে বৌদ্ধরা সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।

বুদ্ধপূর্ণিমা শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি বুদ্ধের শান্তি ও অহিংসার বাণীকে স্মরণ করার দিন। এই দিনে বৌদ্ধরা তাঁদের জীবনকে বুদ্ধের শিক্ষার আলোকে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা নেন। বুদ্ধের শিক্ষা, যেমন চতুরার্য সত্য ও অষ্টাঙ্গিক মার্গ মানুষকে জীবনের দুঃখ থেকে মুক্তির পথ দেখায়। চতুরার্য সত্যে বুদ্ধ ব্যাখ্যা করেছেন যে জীবনে দুঃখ রয়েছে, দুঃখের কারণ রয়েছে, দুঃখ থেকে মুক্তি সম্ভব ও মুক্তির পথও রয়েছে। এই শিক্ষা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জীবনের মূল দিকনির্দেশনা।

বুদ্ধপূর্ণিমার উৎসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এই দিনে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, বুদ্ধমূর্তির স্নান ও সম্প্রদায়ভিত্তিক খাবার বিতরণের আয়োজন করে। শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ভারতের মতো দেশে এই উৎসব ব্যাপকভাবে উদ্‌যাপিত হয়। বাংলাদেশে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এই উৎসব উৎসাহের সঙ্গে উদ্‌যাপন করে। বৌদ্ধবিহারগুলোতে বিশেষ প্রার্থনা, ধর্মীয় আলোচনা ও সম্প্রদায়ভিত্তিক কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশে বুদ্ধপূর্ণিমা একটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয়, যা বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের সুযোগ করে দেয়। বৌদ্ধবিহারগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়, ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং সমবেত প্রার্থনার মাধ্যমে একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই দিনে বৌদ্ধরা বুদ্ধের শান্তি ও অহিংসার বাণীকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং তাঁদের জীবনকে তাঁর শিক্ষার আলোকে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি নেন।

বুদ্ধপূর্ণিমা বিশ্বজুড়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। এই উৎসব শুধু ধর্মীয় তাৎপর্যই বহন করে না, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলে। বুদ্ধের শিক্ষা, যা শান্তি, করুণা ও অহিংসার ওপর ভিত্তি করে, আজও মানবজাতির জন্য প্রাসঙ্গিক ও অনুপ্রেরণাদায়ী। এই উৎসবের মাধ্যমে বৌদ্ধরা তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় ও আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ করেন এবং বিশ্বে শান্তি ও সম্প্রীতির বাণী ছড়িয়ে দেন।

সূত্র: ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’, যার যা ধর্ম, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪