রাখিপূর্ণিমা

রাখিবন্ধন: ভেদাভেদ ভুলে মানবতার উৎসব

১৯০৫ সালের ঘটনা। অবিভক্ত বঙ্গদেশজুড়ে লর্ড কার্জনের বঙ্গচ্ছেদের বিরুদ্ধে মানবতাবাদী বাঙালি জেগে উঠেছিল। হাতে হাত ধরে পথে শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন অনেকেই। রাষ্ট্রনেতা থেকে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা—সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সেদিন ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের রায় তুলে নিতে বাধ‍্য হয়েছিল।

সে সময়েই একদিন অবিভক্ত বঙ্গদেশের রাজধানী কলকাতা শহরের রাজপথে নেমে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে ‘বাংলার ঘরে যত ভাইবোন এক হোক’—এ আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সবাই একে অপরের হাতে রাখি বেঁধে উদ্‌যাপন করেছিলেন সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শ।

প্রত‍িটি অসামাজিক কার্যকলাপের পেছনে যেমন নেতৃত্বের ভূমিকা থাকে, তেমন অসুরদেরও দলে ‘বলি’ নামের এক পরাক্রমশালী দৈত‍্য ছিল, যার অঙ্গুলিহেলনে অসুররা স্বর্গোদ‍্যানে তাণ্ডব করে বেড়াত

যদিও ভারতীয় পুরাণে রাখিবন্ধনের ইতিহাসটি সামান‍্য ভিন্ন। ভবিষ‍্যপুরাণে এ সম্পর্কে একটি কাহিনি আছে। সেকালে স্বর্গপুরীতে বেশ কয়েকজন দৈত‍্য, যাদের চলতি কথায় অসুর বলা হয়, তাদের উপদ্রব বেড়ে গিয়েছিল। নিত‍্যদিন তাদের উপদ্রবে স্বর্গের দেবতারা খুবই বিরক্ত ও নাজেহাল হতে থাকেন। প্রত‍িটি অসামাজিক কার্যকলাপের পেছনে যেমন নেতৃত্বের ভূমিকা থাকে, তেমন অসুরদেরও দলে ‘বলি’ নামের এক পরাক্রমশালী দৈত‍্য ছিল, যার অঙ্গুলিহেলনে অসুররা স্বর্গোদ‍্যানে তাণ্ডব করে বেড়াত।

দেবতারা এমন তাণ্ডবের শিকারে যখন নাজেহাল হচ্ছিলেন, তখন স্বর্গপুরীর রাজা ইন্দ্র দেবতাদের গুরু বৃহস্পতির পরামর্শে শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দৈত‍্যরাজ বলির সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কাশ‍্যপ মুনির কন‍্যা দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী শচী দেবী তখন যুদ্ধযাত্রার প্রারম্ভে মন্ত্রপূত একটি রক্ষাবন্ধনী ইন্দ্রর হাতে বেঁধে দেন। সেই জীবনরক্ষাকারী বন্ধনীই রাখিবন্ধনের আদি রূপ।

ঠিক একই রকম কাহিনি আছে বিষ্ণুপুরাণেও। সেখানে দৈত‍্যদের উপদ্রব থামাতে বিষ্ণুদেব যুদ্ধে নেমেছিলেন বলির সঙ্গে। কিন্তু পরাক্রমশালী বলি হেরে গিয়েও বিষ্ণুকে বাস্তুচ্যুত করে ছাড়েন, যা বিষ্ণুর স্ত্রী মা লক্ষ্মী মেনে নিতে পারেননি। তিনি তখন বলির কাছে গিয়ে তাঁকে ভাই সম্বোধন করে তাঁর হাতে রাখি বেঁধে দেন। লক্ষ্মীর কাকুতি-মিনতিতে সাড়া দিয়ে বলি তখন বিষ্ণুকে লক্ষ্মীর কাছে ফেরার সুযোগ করে দেন।

পুরুর স্ত্রী ক্লওফিস যুদ্ধের প্রাক্কালে আলেকজান্ডারের হাতে রাখি পরিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন, যুদ্ধে পরাস্ত হলেও পুরুর যেন কোনো ক্ষতি তিনি না করেন।

ওপরের দুটি উদাহরণের একটি আধুনিক যুগের, যেখানে ভিন্নমতাদর্শের ভাইয়ে-ভাইয়ে সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে রাখি পরানোর কাহিনি রয়েছে। আর পুরাণের কাহিনিতে দেখা যাচ্ছে, স্বামীর জীবন রক্ষার্থে স্ত্রীর দ্বারা রাখিবন্ধন বা স্বামীর জন‍্য সহোদর না হয়েও ভাই-বোন সম্পর্ক গড়ে রাখি পরানোর পৌরাণিক ইতিহাস।

ইতিহাসের আরও একটি চমকপ্রদ কাহিনি আছে আলেকজান্ডার ও পুরুর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। সেখানে পুরুর স্ত্রী ক্লওফিস যুদ্ধের প্রাক্কালে আলেকজান্ডারের হাতে রাখি পরিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন, যুদ্ধে পরাস্ত হলেও পুরুর যেন কোনো ক্ষতি তিনি না করেন। এভাবেই একের পর এক কিংবদন্তি রচিত হয়েছে রাখিকে কেন্দ্র করে।

যেমন আরেকটি ঐতিহাসিক কাহিনির প্রেক্ষাপট চিতোরে। ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটের সুলতান রাজা বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে চিতোরের রানি কর্ণাবতী সাহায‍্যপ্রার্থীরূপে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের দ্বারস্থ হয়ে তাঁর দরবারে রাখি পাঠান। বোনের পাঠানো রাখি পরে সম্রাট হুমায়ুন সে দাবি পূরণের জন‍্য বাংলার দিকে অভিযান ত‍্যাগ করে রাজস্থানের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু সময়মতো পৌঁছোতে পারেনি হুমায়ুনের সেনাবাহিনি। সে যুদ্ধে চিতোরের রানি কর্ণাবতী পরাজিত হন।

কৃষ্ণর বাহুতে রক্তপাত হচ্ছে দেখে দ্রৌপদী তখন তাঁর শাড়ির আঁচল থেকে খানিকটা কাপড় ছিঁড়ে কৃষ্ণর হাতে বেঁধে দেন। কৃষ্ণ দ্রৌপদীর এমন আচরণে অভিভূত হয়ে যান।

এ ছাড়া মহাভারতে রাখি নিয়ে একটি প্রচলিত কাহিনি আছে। মহাভারতের যুদ্ধে পাণ্ডবদের পরামর্শদাতা ও রথের সারথি কৃষ্ণ যখন তাঁর কবজিতে আঘাত পান, সেই ক্ষতস্থানে রক্তপাত হতে থাকে। কৃষ্ণর বাহুতে রক্তপাত হচ্ছে দেখে দ্রৌপদী তখন তাঁর শাড়ির আঁচল থেকে খানিকটা কাপড় ছিঁড়ে কৃষ্ণর হাতে বেঁধে দেন। কৃষ্ণ দ্রৌপদীর এমন আচরণে অভিভূত হয়ে যান। তিনি তার পর থেকে দ্রৌপদীকে ভগিনীজ্ঞানেই সম্মান করতেন।

পরবর্তী সময়ে পাশা খেলায় হেরে গিয়ে যুধিষ্ঠির যখন কৌরবদের কাছে রাজ‍্য, সম্পত্তিসহ দ্রৌপদীকেও তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তখন কৌরবরা লালসায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে থাকে। কৃষ্ণ তখন অলৌকিক ক্ষমতাবলে বস্ত্র সরবরাহ করে ভগিনী দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেছিলেন।

ইতিহাস ও পুরাণের নানা কাহিনি থাকা সত্ত্বেও বর্তমানকালে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ও প্রান্তে দেখা যায় শুধু ভাই-বোনের মধ‍্যেই রাখি পরানোর ঝোঁক। রাখিপূর্ণিমার দিন বোনেরা সাধারণত দাদা বা ভাইদের হাতে একটি পবিত্র সুতা বেঁধে দিয়ে ভাইয়ের মঙ্গল কামনা ও জীবনরক্ষার প্রার্থনা করে থাকেন। তবে আজকাল হিন্দুরা ছাড়াও জৈন, বৌদ্ধ ও শিখরাও দেখা যায় রাখিবন্ধন উৎসবে সামিল হচ্ছেন।

আধুনিক কালে দেশে দেশে মানুষে মানুষে এত বিরোধ–বিভেদের মধ্যে যদি জাতি–ধর্মনির্বিশেষে গভীর সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীকী এই বৈশিষ্ট্যকে রাখিবন্ধনের মাধ্যমে ভাই-বোনের ছোট্ট পারিবারিক বৃত্তের বাইরে বৃহত্তর সমাজে ফিরিয়ে আনা যায়, তবে মানবসভ্যতার বিকাশে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নিশ্চিতভাবেই হ্রাস পাবে।

দীপান্বিতা দে: শিশুতোষ গ্রন্থপ্রণেতা ও প্রাবন্ধিক