মাতৃপূজা হয়ে ওঠে মুক্তির পূজা, মানুষের পূজা—এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে শারদীয় দূর্গাপূজার মহাষষ্ঠীতে ভক্তরা
মাতৃপূজা হয়ে ওঠে মুক্তির পূজা, মানুষের পূজা—এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে শারদীয় দূর্গাপূজার মহাষষ্ঠীতে ভক্তরা

আমার শৈশব ও পুলপাড়ের পূজা

শৈশব থেকেই শুনে আসছি বারো মাসে তেরো পার্বণ। নানা রকমের পূজা। সবচেয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে উদ্‌যাপিত হতো দুর্গাপূজা। তার আয়োজন শুরু হতো এক-দেড় মাস আগে থেকেই।

আমরা থাকতাম মোহাম্মদপুরে। তখনো মোহাম্মদপুর নাম হয়নি। লালমাটিয়া বলত। কাছে বাজার বলতে ছিল রায়েরবাজার। হাঁটাপথে দুই মাইল। মাঝামাঝি জায়গায়টার নাম পুলপাড়। এখানে একটি খালের ওপর পুল ছিল। সে জন্যই জায়গার নাম পুলপাড়। এখন পুল হয়ে গেছে কালভার্ট।

রায়েরবাজার এলাকার বেশির ভাগ পরিবার ছিল সনাতন ধর্মের। পেশায় কুমার। লোকে এটিকে পালপাড়াও বলত। সেখানে তারা মাটির তৈজসপত্র বানাত—হাঁড়ি-পাতিল, সরা, কলসি, বদনা, মটকা, কত–কী। পুলপাড়ে বিশাল আকারে পূজামণ্ডপ তৈরি হতো। প্রতিবছর দল বেঁধে পূজা দেখতে যেতাম। ওই সময় স্কুলে লম্বা ছুটি থাকত। কমপক্ষে দুই সপ্তাহ। আমরা বলতাম পূজার ছুটি।

পুলপাড়ের মণ্ডপে আমার প্রথম পরিচয় দুর্গার সঙ্গে। সেই সঙ্গে চেনা হয় তাঁর চার সন্তানকে—লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক। কার্তিকের চেহারাটা সিনেমার নায়কের মতো। গণেশের শুঁড় দেখে খুব আনন্দ হতো। মহিষাসুরকে দেখে ভয় হতো। তার বড় বড় চোখ, মুখে ইয়া বড় গোঁফ। তার বুকে দুর্গার বর্শা। এসবের ব্যাখ্যা জেনেছি আরও পরে। আর বুঝেছি বাংলা ভাষায় দুর্গা পরিবারের প্রভাব নানান রূপকে। কন্যাসন্তানের জন্ম হলে বলি, আজ যেন ঘরে লক্ষ্মী এসেছে। পরীক্ষার ফল ভালো হলে শুনি, সরস্বতী ধরা দিয়েছে। কারও ছেলেকে দেখে কেউ বলে ওঠে, ছেলেটা ভারি সুন্দর, একেবারে কার্তিকের মতো চেহারা।

কয়েক দিন ধরেই শোনা যেত ঢাকের আওয়াজ। সেই সঙ্গে কাঁসর ঘণ্টা। সকালে অর্চনা হতো। দেখতাম, একজন পুরোহিত নতুন ধুতি পরে হাতে একটা মালসায় জ্বলন্ত ধূপ-ধুনা নিয়ে মন্ত্র পড়ছেন। গায়ে জামা নেই। ঘাড়ের ওপর দিয়ে কোমর পর্যন্ত প্যাঁচানো পইতা। সমবেত নারীরা থেমে থেমে শাঁখ বাজাচ্ছেন, উলুধ্বনি দিচ্ছেন। শিশুদের গায়ে নতুন জামা। এখন যেমন মহালয়া, তারপর ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত নানান আচার-অনুষ্ঠান, তখন সেটি বুঝতাম না। বিসর্জন শব্দটা তখনই শুনেছি। সবাই দল বেঁধে দুর্গাকে তার পুরো পরিবারসহ মাথায় নিয়ে যাচ্ছে। পাশেই বুড়িগঙ্গা। সেখানে ফেলে দিচ্ছে। তখন একটু খারাপ লাগত। এত যত্ন করে বানানো প্রতিমা এভাবে জলে ফেলে দিচ্ছে! এখন তার অর্থ বুঝতে পারি।

১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল অঞ্চলজুড়ে। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। মোহাম্মদপুরের দাঙ্গাবাজরা রায়েরবাজারে আগুন দেয়। অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। অনেকেই তখন এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। একটি ছন্দপতন হয়। পুলপাড়ের পূজা বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকে।

বাহাত্তর সালে পুলপাড়ে আবার শুরু হয় পূজা। সেখানে আর যাওয়া হয়নি। আমাদের পাড়ার কাছে বাঁশবাড়ীতে দুর্গাপূজার নতুন মণ্ডপ হয়। পুলিশ পাহারা দেয়। সেখানে গিয়েছি কয়েকবার; কিন্তু শৈশবের আনন্দটা তত দিনে ফিকে হয়ে গেছে।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক