তাফসিরে তাবারির একটা পার্সিয়ান সংস্করণের চিত্র
তাফসিরে তাবারির একটা পার্সিয়ান সংস্করণের চিত্র

ইমাম তাবারি: জ্ঞানী, দুঃসাহসী, মর্মান্তিক জীবন

মুসলিম মনন ও মনীষার ইতিহাসে যে কয়েকজন মনীষী আপন প্রতিভার দ্যুতিতে স্বতন্ত্র এক জগৎ নির্মাণ করেছেন, ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবন জারির আত-তাবারি (২২৪-৩১০ হিজরি) তাঁদের মধ্যে অবিস্মরণীয়।

তাঁর পূর্ণ নাম মুহাম্মদ ইবন জারির ইবন ইয়াযিদ ইবন কাসির ইবনে গালিব। তিনি ছিলেন একাধারে কোরআনের এক অবিসংবাদিত ভাষ্যকার, নিপুণ ইতিহাসবিদ এবং প্রাজ্ঞ ফকিহ। তাঁকে ‘ইমামুল মুফাসসিরিন’ বা মুফাসসিরদের ইমাম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

২২৪ হিজরি সনে তাবারিস্তানের উর্বর ভূমিতে ইমাম তাবারির জন্ম। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে আশ্চর্য মেধা ও প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। তাঁর পিতা আল্লাহপ্রদত্ত এই গুণ বুঝতে পেরে শৈশব থেকেই জ্ঞানের পথে তাঁকে পরিচালিত করেন। পুত্রের পড়াশোনা, ভ্রমণ ও গবেষণায় পূর্ণ মনোযোগ নিশ্চিত করতে নিজের জমির আয় পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন।

ধীরে ধীরে তিনি আরও প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠেন। নিজস্ব ইজতিহাদ তাঁকে স্বতন্ত্র পথে চালিত করে, তখন এই পরিবর্তনও হাম্বলিদের চোখে তাঁকে সন্দেহভাজন করে তোলে।

সেই মেধার স্বাক্ষর ইমাম তাবারি রেখেছিলেন জীবনের প্রতিটি ধাপে। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন হিফজ করেন। আট বছরে নামাজের ইমামতিতে দাঁড়ান। নয় বছরে হাদিস লিপিবদ্ধ করার মতো গুরুদায়িত্বে মনোনিবেশ করেন।

ইমাম তাবারির কোরআন তিলাওয়াত ছিল শ্রুতিমধুর। ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল ইমাম শাফিঈর মাযহাব অনুসরণের মাধ্যমে। কিন্তু অচিরেই তাঁর স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞানের গভীরতা তাঁকে অনুকরণের পথ থেকে স্বতন্ত্র ইজতিহাদের বিশাল প্রান্তরে নিয়ে আসে। তিনি এক স্বয়ংসম্পূর্ণ মুজতাহিদ ইমাম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।

জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের এমন এক প্রোজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের চারপাশে জ্ঞানপিপাসু পতঙ্গের মতো সমবেত হয়েছিলেন সমকালের বহু শ্রেষ্ঠ বিদ্যার্থী।

ইমাম তাবারির লেখনী থেকে উৎসারিত হয়েছিল জ্ঞানজগতের অমূল্য সব গ্রন্থ। এর মধ্যে অন্যতম, মুসলিম সমাজে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য কুরআনের ভাষ্যগ্রন্থ তাফসিরুত তাবারি (জামিউল বায়ান আন তা’বিলি আয়িল কুরআন) এবং ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ তারিখুত তাবারি (তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক)।

অথচ যাঁর কীর্তি এত ভাস্বর, তাঁকেও জীবনের সায়াহ্নে নিদারুণ এক সংকট ও পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল; জীবনের শেষভাগে তিনি যখন বাগদাদে স্থায়ী হন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১৪/২৬৯)

বাগদাদের জ্ঞানকেন্দ্র ইমাম তাবারির স্বাধীন পাণ্ডিত্য ও স্বতন্ত্র চিন্তার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। দীর্ঘ সফরের মাধ্যমে সংগৃহীত জ্ঞান তিনি এখানে সংকলন করতে শুরু করেন। বিভিন্ন মতামতের চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে নিজের স্বতন্ত্র মাযহাব—যা ‘জারিরি মাযহাব’ নামে পরিচিত—প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান।

কিন্তু ইমাম তাবারির এই পদক্ষেপ তৎকালীন বাগদাদের রক্ষণশীল পরিমণ্ডলে প্রচণ্ড সংঘাতের জন্ম দেয়। সেই সময়ে বাগদাদ ছিল হাম্বলি মাযহাবের অনুসারীদের এক অপ্রতিহত দুর্গ। ইবনুল আসিরের বর্ণনা মতে, সংখ্যায় ও প্রভাবে তাঁরা ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। (আল-কামিল ফিত তারিখ–ইবনুল আসির, ৮/১৩৪)

এই হাম্বলিরাই ইমাম তাবারির বিরুদ্ধে তীব্র হট্টগোল ও প্রতিরোধ সৃষ্টি করে এবং তাঁর সম্পর্কে যা খুশি তাই বলতে থাকে। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১১/১৮৮-১৮৯)

এই গভীর বিদ্বেষের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ছিল একাধিক কারণ।

প্রথমত, সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে ইমাম তাবারির একটা সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। তিনি গবেষণা ও পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল ছিলেন মূলত একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও হাদিসশাস্ত্রের হাফেজ। ফকিহ বা আইনবিদ হিসেবে তাঁর পরিচিতি প্রধান ছিল না।

এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই তিনি যখন ইখতিলাফুল ফুকাহা (ফকিহগণের মতপার্থক্য) শীর্ষক গ্রন্থটি রচনা করেন, তখন ফকিহদের তালিকায় ইমাম আহমদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেননি। (আল-কামিল ফিত তারিখ, ইবনুল আসির, ৮/১৩৪)

ইমাম তাবারির এই সিদ্ধান্ত বাগদাদের হাম্বলি সমাজে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। তারা যখন তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করল, তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তিনি ফকিহ ছিলেন না, বরং মুহাদ্দিস ছিলেন।’

পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যে শহরের সেনাপ্রধানকে সহস্রাধিক সৈন্য নিয়ে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করতে হয়েছিল। জনতাকে হাম্বলিরাই তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল।

এই একটি কথাই যথেষ্ট ছিল তাঁর বিরুদ্ধে সব শক্তিকে একত্রিত করার জন্য। তারা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী অবস্থান নেয় এবং তাঁকে গৃহবন্দি করে। এমনকি তাঁর বাড়িতে পাথর পর্যন্ত নিক্ষেপ করে। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১৪/২৭৪)

পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যে শহরের সেনাপ্রধানকে সহস্রাধিক সৈন্য নিয়ে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করতে হয়েছিল। জনতাকে হাম্বলিরাই তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। অন্য ইমামগণও এই নির্মমতার সাক্ষী। ইমাম আবু বকর ইবন খুযাইমার মতো মনীষী পর্যন্ত মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘হাম্বলিরা তাঁর ওপর জুলুম করেছে।’ (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১৪/২৭৫)

দ্বিতীয়ত, ইমাম তাবারি বাগদাদে দশ বছর ধরে ইমাম শাফিঈর মাযহাবের প্রচার করেছিলেন। ইবন সুরাইজের উস্তাদ ইবন বাশশার আল-আহওয়ালের মতো ব্যক্তিত্ব তাঁর কাছ থেকে এই মাযহাবের জ্ঞান লাভ করেন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১৪/২৭৫)

ধীরে ধীরে তিনি আরও প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠেন। নিজস্ব ইজতিহাদ তাঁকে স্বতন্ত্র পথে চালিত করে, তখন এই পরিবর্তনও হাম্বলিদের চোখে তাঁকে সন্দেহভাজন করে তোলে।

তৃতীয়ত, তিনি হাম্বলিদের মতামতের খণ্ডন করে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তবে এই বিদ্বেষ ও নিপীড়নকে যিনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন এবং সাধারণ মানুষকে ইমাম তাবারির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন, তিনি ছিলেন বাগদাদের হাম্বলিদের তৎকালীন প্রধান, হাফেজ আবু বকর ইবন আবি দাউদ।

বাগদাদে ইমাম তাবারির সমাধি

ইমাম যাহাবি লেখেন, ‘(সেই সময়ে) হাম্বলিরা ছিল আবু বকর ইবন আবি দাউদের অনুসারী একটি দল। তাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল এবং তারা ইবন জারিরের বিরুদ্ধে হট্টগোল শুরু করে। তিনি অনেক কষ্ট ও নির্যাতনের শিকার হন এবং নিজ গৃহে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হন। আমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই’। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১৪/২৭৭)

হাফেজ ইবনুল আসিরও লেখেন, ‘হাম্বলিরা জনগণকে তাঁর কাছে যেতে বাধা দিত।’ (আল-কামিল ফিত তারিখ, ইবনুল আসির, ৮/১৩৫)

এমনকি ইবন কাসিরের মতে, কিছু মূর্খ লোক তাঁকে ধর্মদ্রোহিতা (ইলহাদ) এবং রাফেযি (চরমপন্থী শিয়া) হওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির, ১১/১৪৬)

এত লাঞ্ছনা, অপবাদ আর অবিচারের মুখেও ইমাম তাবারি তাঁর জ্ঞান, দুনিয়াবিমুখতা ও দৃঢ়তায় পর্বতের মতো অটল ছিলেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির, ১১/১৪৬)

কিন্তু সত্যের আলো কখনো নিভে যায় না। যখন এই খবর ছড়িয়ে পড়ল, তখন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে তাঁর বাড়ির প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে জানাজার নামাজ আদায় করে।

তিনি একবার হাম্বলিদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য এবং নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার প্রজ্ঞাপূর্ণ প্রয়াসে একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। (মু’জামুল উদাবা, ইয়াকুত আল-হামাওয়ি, ৮/৫৯)

কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। তাদের বিদ্বেষ কেবল বেড়েই চলেছিল। অবশেষে এই জ্ঞানতাপস নিজ গৃহেই অন্তরীণ অবস্থায় রবের ডাকে সাড়া দেন। ৩১০ হিজরি সালের ২৬ শাওয়াল রবিবার মাগরিবের সময় সেই মহান আত্মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

তাঁর প্রতি হাম্বলিদের আক্রোশ এতটাই তীব্র ছিল যে দিনের বেলায় তাঁর দাফনে বাধা দেওয়ার জন্য তারা সমবেত হয়েছিল। তাই তাঁর অনুসারীরা হাম্বলিদের ভয়ে রাতের আঁধারে তাঁর নিজ গৃহেই তাঁকে দাফন করতে বাধ্য হন। (আল-কামিল ফিত তারিখ, ইবনুল আসির, ৮/১৩৪)

কিন্তু সত্যের আলো কখনো নিভে যায় না। যখন এই খবর ছড়িয়ে পড়ল, তখন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে তাঁর বাড়ির প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে জানাজার নামাজ আদায় করে। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির, ১১/১৪৭)

এই মর্মান্তিক ঘটনা ইমাম তাবারির জীবনের এক নিদারুণ অধ্যায়, যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সমাজের মাযহাবগত গোঁড়ামির চিত্র কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

এমনকি তাঁর কালজয়ী তাফসির, যা তিনি জীবনের শেষ দশকে (২৮০-২৯০ হিজরি) বাগদাদে বসেই রচনা করেছিলেন, তার ওপরেও এই সংকটের ছায়া পড়েছিল বলে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন।

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস জাহিদ আল-কাউসারির মন্তব্যটি এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন: ‘তাঁদের (হাম্বলিদের) সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁর তাফসির এবং অন্যান্য কিছু গ্রন্থে কিছু শব্দ সংযোজন করার চেষ্টাও ফলপ্রসূ হয়নি। আর আমরা জানি, ইসলামি শরিয়ায় ‘চাপের মুখে কৃতকর্ম’-এর জন্য ভিন্ন বিধান রয়েছে। এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ইবন মিসকাওয়াইহ-এর তাজারিবুল উমাম, ইয়াকুত আল-হামাওয়ির মু’জামুল উদাবা এবং ইবনুল আসিরের আল-কামিল গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে’। (মাকালাতুল কাউসারি, জাহিদ আল-কাউসারি, পৃষ্ঠা ৩১৭)

ইমাম তাবারির জীবন আমাদের শেখায়, সত্যনিষ্ঠ জ্ঞানচর্চা কোনো সহজ পথ নয়। তিনি সত্যের আলোয় আলোকিত করতে চেয়েছিলেন মুসলিম সমাজকে। কিন্তু সেই সমাজই তাঁকে ভুল বোঝে। চার দেয়ালের ভেতর গৃহবন্দী করে দেয়।

তাঁর ওপর অন্যায়, অপবাদ ও নির্যাতন নেমে এলেও তিনি নতি স্বীকার করেননি। শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত সত্য ও জ্ঞানের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। ব্যক্তি তাবারি হয়তো বিরোধীদের প্রতিরোধে নিঃশেষ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর তাফসির, ইতিহাস, তাঁর চিন্তা ও তাঁর জ্ঞানের দীপ আজও আলোকিত করছে মুসলিম বিশ্বকে।