
মুসলিম স্থাপত্যের ইতিহাস যেন এক জীবন্ত গল্প, যেখানে শিল্প, সংস্কৃতি আর ধর্মের মেলবন্ধন এক অপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ, জেরুজালেমের কুব্বাতুস সাখরা (ডোম অব রক)—এই স্থাপত্যগুলো ইসলামের প্রথম শতাব্দীর গৌরবের সাক্ষী; কিন্তু পশ্চিমা ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ দাবি করেন, এসব স্থাপত্য আরব বা মুসলিমদের সৃষ্টি নয়; বরং বাইজান্টাইন বা অন্য অমুসলিম কারিগরদের হাতে তৈরি।
এই দাবি কি সত্য? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা?
পশ্চিমা কিছু ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন, মুসলিম স্থাপত্যের মূল উৎস বাইজান্টাইন বা পারস্যের মতো পূর্ববর্তী সভ্যতা। তাঁরা বলেন, আরব মুসলিমদের এতে কোনো মৌলিক অবদান নেই। উদাহরণ হিসেবে তারা দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ (৭০৬-৭১৪ খ্রিষ্টাব্দ) ও কুব্বাতুস সাখরা (৬৯১ খ্রিষ্টাব্দ) নির্মাণের কথা তুলে ধরেন। তাঁদের মতে, এই স্থাপত্যের জটিল মোজাইক ও নকশা বাইজান্টাইন কারিগরদের কাজ। এই দাবির পেছনে তারা কিছু ইসলামী ঐতিহাসিকের বর্ণনার দুর্বলতা ব্যবহার করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ ঐতিহাসিক মাকদিসি লিখেছেন, খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক দামেস্কের মসজিদের জন্য বাইজান্টাইন সম্রাটের কাছ থেকে কারিগর আনিয়েছিলেন। (মাকদিসি, আহসান আত-তাকাসিম ফি মারিফাত আল-আকালিম, মিনিস্ট্রি অব কালচার অ্যান্ড ন্যাশনাল গাইডেন্স, দামেস্ক, ১৯৮০)
উমারি বলেন, ওয়ালিদ রোমের সম্রাটকে চিঠি লিখে ২০০ কারিগর পাঠাতে বলেন, অন্যথায় যুদ্ধের হুমকি দেন। (উমারি, মাসালিক আল-আবসার ফি মামালিক আল-আমসার, খণ্ড ১, দারুল কুতুব আল-মিসরিয়া, কায়রো: ১৯২৪ খ্রি.)
আল-উয়ুন ওয়াল-হাদায়িকের একটি বর্ণনায় বলা হয়, সম্রাট এক লাখ দিনার, এক লাখ কারিগর, এবং ৪০টি মোজাইকের চালান পাঠান। (আল-উয়ুন ওয়াল-হাদায়িক ফি আখবারিল হাকায়িক, খণ্ড ৩, ডি জোয়া সংস্করণ, ব্রিল প্রেস: ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দ)
কিন্তু এই সংখ্যাগুলো অতিরঞ্জিত মনে হয়। এত বিপুলসংখ্যক কারিগরের প্রয়োজন ছিল কি? এই প্রশ্ন আমাদের ইতিহাসের গভীরে যেতে বাধ্য করে।
পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের বড় ভুল হলো ইসলামি সূত্রে ব্যবহৃত ‘রুম’ ও ‘কিব্ত’ শব্দের ভুল ব্যাখ্যা। তারা ধরে নিয়েছেন, ‘রুম’ মানে বাইজান্টাইন বা শামের খ্রিষ্টান, আর ‘কিব্ত’ মানে মিসরের খ্রিষ্টান; কিন্তু ইসলামি সূত্রে এই শব্দগুলোর অর্থ অনেক বিস্তৃত।
রুম: ইসলামি সূত্রে ‘রুম’ শুধু বাইজান্টাইনদের বোঝায় না। এটি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণকারী আরব গোত্রগুলোকেও (রুম আল-আরব) বোঝায়, যারা পরে ইসলাম গ্রহণ করে। ইবন দুকমাক কিছু গোত্রের নাম উল্লেখ করেছেন, যেমন বালি বিন আমর, আদওয়ান, আজদের কিছু শাখা (সারাদ, বনু বাহর, বনু সালামান), ইয়াশকুর বিন লাখম, হুজাইল বিন মুদরিকা এবং বনু আল-আজরাক। এই গোত্রগুলো ইসলাম গ্রহণের পরও তাদের ‘রুম’ পরিচয় ধরে রেখেছিল।
কিব্ত: একইভাবে, ‘কিব্ত’ শব্দটি শুধু মিশসরের খ্রিষ্টানদের বোঝায় না; বরং মিসরের সাধারণ জনগণকে বোঝায়। ইমাম রাযি বলেন, ‘‘‘কিব্ত’’ মানে মিসরের অধিবাসী, তাদের মূল পরিচয়।’ ইসলামি সূত্রে কিব্তি মাস, পিরামিড (কিব্তি রাজাদের সমাধি) এবং তাঁদের প্রাচীন ভাষা ও বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। ((রাযি, মুখতার আস-সিহাহ, দারুল বাজ লিত তিবাআ ওয়ান নাশর, বৈরুত)
মাকরিযি উল্লেখ করেন, তিনজন নবী কিব্তিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন: ইবরাহিম (আ.) হাজেরার সঙ্গে, ইউসুফ (আ.) আইন শামসের মেয়ের সঙ্গে এবং রাসুল (সা.) মারিয়া কিব্তিয়ার সঙ্গে। ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তিরাও, যেমন মারিয়া কিব্তি বা আবু রাফি কিব্তি তাঁদের কিব্তি পরিচয় বজায় রেখেছিলেন।
এই ভুল ব্যাখ্যার কারণে পশ্চিমা পণ্ডিতেরা ধরে নিয়েছেন, মুসলিম স্থাপত্যের কাজ শুধু বাইজান্টাইন বা খ্রিষ্টান কারিগররা করেছেন; কিন্তু বাস্তবে শাম ও মিসরে ইসলাম গ্রহণকারী আরব ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে দক্ষ কারিগর ছিলেন। (মাকরিযি, আল-মাওয়ায়িজ ওয়াল-ইতিবার, বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৪১৮ হিজরি)
মুসলিম বিজয়ের পর শাম (লেভান্ট) ও মিসরে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে শাম ও মিসর জয়ের পর থেকে ৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে কুব্বাতুস সাখরা (বাইতুল মোকাদ্দাসের সোনালি গম্বুজ) নির্মাণ পর্যন্ত ৫৫ বছরে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন বা হিজরত করে এই অঞ্চলে আসেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দক্ষ স্থপতি ও কারিগর। খলিফা আবদুল মালিক ও তাঁর পুত্র ওয়ালিদ এই স্থানীয় কারিগরদের দিয়েই কুব্বাতুস সাখরা ও উমাইয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদগুলোর জটিল মোজাইক কাজও তাঁরা করেছিলেন।
আরব রুমদের স্থাপত্য দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায় সিরিয়ার দুরা-ইউরোপোসের মন্দিরে। এই মন্দিরগুলো বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের আগমনের এক শতাব্দী আগে নির্মিত। এর দেয়ালচিত্র, যেমন ইহুদি ও পালমিরার মন্দিরের চিত্র, দামেস্কের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত।
আরেকটি উদাহরণ হলো জেরুজালেমের চার্চ অব হলি সেপালচার (৩২৬ খ্রিষ্টাব্দ), যা নির্মাণ করেন জেনোবিয়াস নামের একজন আরব স্থপতি, যাঁর নামে গ্রিক প্রত্যয় যোগ হয়েছিল। (ফরিদ শাফি, আল-ইমারা আল-আরাবিয়া ফি মিসর আল-ইসলামিয়া: আসর আল-ওয়ালাত, মিসরীয় জেনারেল বুক অথরিটি, কায়রো, ১৯৯৪)
এই দক্ষতা উমাইয়া যুগে মুসলিম স্থাপত্যে ব্যবহৃত হয়। খ্রিষ্টধর্মের সময় আরব রুমরা বাইজান্টাইন শিল্পে অবদান রেখেছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণের পর তাঁরা তাঁদের দক্ষতা ইসলামি স্থাপত্যে প্রয়োগ করেন। তাই এত বিপুলসংখ্যক বাইজান্টাইন কারিগরের প্রয়োজন ছিল না। (ইবন দুকমাক, আল-ইনতিসার লিওয়াসিতাত উকদিল মিসার, বৈরুত: দারুল আফাক আল-জাদিদা)
মুসলিম স্থাপত্য কেবল পূর্ববর্তী শৈলীর অনুকরণ নয়। প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ওলেগ গ্রাবার বলেন, মুসলিম স্থাপত্য দ্রুত বিকশিত হয়; কারণ মুসলিমরা তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
কুব্বাতুস সাখরা বা মসজিদে নববী কেবল ঐতিহাসিক গল্পে পরিণত হয়নি; বরং ইসলামি পরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই স্থাপত্য অন্য সংস্কৃতি থেকে আলাদা এবং স্পষ্টভাবে ইসলামি। যেমন কুব্বাতুস সাখরার গম্বুজ ও মোজাইক কাজ ইসলামি শিল্পের একটি নতুন ভাষা তৈরি করেছে, যা পরবর্তী শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বাইজান্টাইন শিল্পের কিছু প্রভাব থাকলেও, ইসলাম স্থাপত্যের নকশা, উদ্দেশ্য এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। উমাইয়া মসজিদের উঠান, মিনার এবং কুব্বাতুস সাখরার গম্বুজ ইসলামের একত্মবাদী দর্শন ও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ। এই স্থাপত্যগুলো মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক চাহিদা পূরণ করত। (গ্রাবার, আর্লি মুসলিম আর্কিটেকচার, পৃ. ৪৩-৫২, অক্সফোর্ড: ক্লারেন্ডন প্রেস, ১৯৬৯)
মুসলিম স্থাপত্য আরব ও মুসলিম কারিগরদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতার ফল। পশ্চিমা দাবি যে এটি শুধু বাইজান্টাইন কারিগরদের কাজ, ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে। শাম ও মিসরের আরব রুম ও কিব্তিরা তাদের পূর্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে ইসলামী স্থাপত্যে অবদান রাখেন।
কুব্বাতুস সাখরা ও উমাইয়া মসজিদ শুধু স্থাপত্য নয়, ইসলামের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক পরিচয়ের প্রতীক। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইসলামি সভ্যতা শুধু ধার করেনি; বরং নিজের স্বতন্ত্র ছাপ রেখেছে, যা আজও বিশ্বকে মুগ্ধ করে।
সূত্র: ইসলাম অনলাইন