বদরের যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ
বদরের যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ

বদরের যুদ্ধবন্দীদের বিচার

বদর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে মক্কার কুরাইশরা। তাদের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছে মুসলিম যোদ্ধাদের হাতে। রাসুল (সা.) একেকজন বন্দীকে একজন বা দুজন সাহাবির দায়িত্বে দিয়ে দিলেন, তাঁরা আপাতত তাদের পাহারা দিয়ে রাখবেন এবং পরবর্তী সময়ে নিরাপদে মদিনায় নিয়ে যাবেন। আবু আজিজের পাহারার দায়িত্ব দেওয়া হলো তার মুসলমান ভাই মুসআব ইবনে উমায়ের এবং আবুল ইয়াসারকে, যেহেতু তিনিই তাকে বন্দী করেছিলেন।

 আবুল ইয়াসার যখন আবু আজিজের হাত বাঁধছিলেন তখন মুসআব ছিলেন সেখানে। তিনি আবুল ইয়াসারকে বললেন, ‘এর হাত শক্ত করে বাঁধো। তার মা ধনী মানুষ, তার মুক্তিপণ হিসেবে তুমি হয়তো মোটা অঙ্কের অর্থ পাবে।’

 এ কথা শুনে আবু আজিজ বেদনার্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমার ভাই হয়ে তুমি এভাবে কথা বললে?’

 মুসআব আবু আজিজের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘তুমি নয়, এখন আবুল ইয়াসার আমার ভাই।’

 ইমানের প্রদীপ্ত শিখা এভাবেই জ্বলে উঠেছিল সেদিন বদর প্রান্তরে। রক্ত সম্পর্কের চেয়ে ধর্মের বন্ধন সেদিন দৃঢ় করেছিল ইতিহাসের আস্তিন।

 যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ (গনিমত) বণ্টন নিয়ে মুসলিম বাহিনীতে কিছুটা মতদ্বৈধতা দেখা দিল। অনেক মুজাহিদ রাসুলের (সা.) নিরাপত্তা ও বাহিনীর রসদপত্রের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন, তারা সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করার সুযোগ পাননি। যারা রণাঙ্গনে লড়েছেন, যুদ্ধ লব্ধ সকল সম্পদ তাদের হস্তগত হয়েছে। যুদ্ধের পুরোনো নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে যে যোদ্ধা যেসব সম্পদ হস্তগত করবে, সেগুলো তাঁর নিজস্ব সম্পদ বলে পরিগণিত হবে। সে হিসেবে নিরাপত্তারক্ষীরা কোনো গনিমতের ভাগীদার হবেন না। কিন্তু তারাও সম্পদের ভাগ চাইছেন।

 এটা ইসলামের প্রথম যুদ্ধ, তাই রাসুলও গনিমতের ব্যাপারে ইসলামি নীতিমালা কী হবে—সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। এরই মধ্যে আল্লাহ যুদ্ধ লব্ধ সম্পদের ব্যাপারে ঐশী নির্দেশনা অবতীর্ণ করেন। যুদ্ধ লব্ধ সব সম্পদ পাঁচ ভাগ করে তার এক ভাগ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য সংরক্ষণ করে বাকি চার ভাগ মুজাহিদদের মাঝে সমহারে বণ্টন করে দেওয়া হবে।

এবার বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের পালা। রাসুল (সা.) প্রথমে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ও পরামর্শদাতা আবু বকরের কাছে জানতে চাইলেন, ‘বন্দীদের ব্যাপারে তোমার কী অভিমত?’

আবু বকর তাঁর স্বভাবসুলভ দয়ার্দ্রতা ও উদারচিত্তের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল! এ লোকগুলো আপনারই স্বজন ও পূর্বপরিচিত, তাদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করি। এর ফলে নৈতিকভাবে আমরা কাফেরদের ওপর বিজয়ী হব। আবার হতে পারে ভবিষ্যতে আল্লাহ তাদের ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য দান করবেন।’

 আবু বকরের (রা.)  মতামতের পর রাসুল (সা.) উমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) কাছে জানতে চাইলেন, ‘ইবনে খাত্তাব, বন্দীদের ব্যাপারে তোমার অভিমত জানাও।’

উমর(রা.) কোনো ধরনের দয়ার ধার ধারলেন না। তিনি বললেন, ‘আবু বকর (রা.)  যে মতামত ব্যক্ত করেছেন আমার অভিমত সে রকম নয়। আমার অভিমত হলো, তাদের আমাদের হাতে তুলে দিন আর আমরা তাদের ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলি। আলির (রা.) কাছে তার ভাই আকিলকে ন্যস্ত করুন, সে তাকে হত্যা করবে। আমার কাছে আমার কোনো আত্মীয়কে প্রদান করুন, যাতে আমি নিজ হাতে তাকে হত্যা করতে পারি। এই লোকগুলো মক্কায় আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, আপনাকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে, মুসলিমদের নিপীড়ন করেছে। তাই উচিত হবে তাদের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া।’

 মদিনার আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা বললেন, ‘কোনো স্থানে অনেক কাঠ একত্রিত করে আগুন জ্বালিয়ে সেখানে এদের নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারা হোক।’

 মক্কার আব্বাস ইবনে মুত্তালিব বন্দী হয়েছেন। তিনি হাত বাঁধা অবস্থায় ছিলেন সেখানে। উমরের কথা শুনে তিনি বললেন, ‘আপনি এমন কথা বলছেন, যার ফলে মানুষের মাঝে পরস্পরের আত্মীয়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধ শেষ হয়ে যাবে।’

রাসুল(সা.)  কারও মতামত গ্রহণ না করে সেখান থেকে উঠে গেলেন। সাহাবিরা পরস্পর কথা বলতে লাগলেন। কেউ বললেন রাসুল (সা.) আবু বকরের (রা.) মতামত গ্রহণ করবেন, কেউ বললেন উমরের(রা.) কথা আবার আবদুল্লাহর কথার পক্ষে মত দিলেন।

রাসুল (সা.) কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন। সবাইকে লক্ষ করে দীর্ঘ এক বক্তব্য দিয়ে আবু বকর এবং উমর দুজনের মতামতকেই সম্মান জানালেন তিনি। তারপর বললেন, ‘হে আমার সাহাবিরা! তোমরা এখন অর্থাভাবে আছ, অর্থ ও সম্পদের প্রয়োজন রয়েছে তোমাদের। এ কারণে আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, প্রত্যেক বন্দীকে উচ্চ মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে দেওয়া হবে। কারও পরিবার মুক্তিপণ দিতে অস্বীকার করলে তার ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

রাসুলের (সা.) সিদ্ধান্ত শোনার পর দ্বিমত করার মতো কেউ ছিল না। মুক্তিপণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হলো বন্দীদের আর্থিক অবস্থা অনুসারে এক থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। একেবারে কপর্দকশূন্য যারা, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে যারা লেখাপড়া জানে, তারা মদিনার ১০ জন শিশুকে আরবি পড়া ও লেখা শেখাবে। ১০ জন শিশু যখন পড়তে ও লিখতে শিখবে, তখন তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে এবং এটিই তাদের মুক্তিপণ হিসেবে বিবেচ্য হবে।

 বন্দীদের ব্যাপারে নির্দেশনা শোনানোর পর রাসুল (সা.) আফসোস করে বললেন, ‘আজ যদি মক্কার মুতইম ইবনে আদি জীবিত থাকত এবং এসব বন্দীর মুক্তির ব্যাপারে সুপারিশ করত, তাহলে নিঃশর্তে আমি তাদের মুক্ত করে দিতাম।’

মুতইম ইবনে আদি কিছুদিন আগে মক্কায় মৃত্যুবরণ করেছেন। রাসুল (সা.) মক্কায় থাকতে নানাভাবে তিনি তাঁকে এবং তাঁর সাহাবিদের সাহায্য করতেন। ইসলাম গ্রহণ না করলেও মুসলিমদের প্রতি তাঁর সহানুভূতির কথা রাসুল কখনো ভোলেননি।