মানুষের জীবনে জ্ঞান এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। কিন্তু সব জ্ঞান সমান নয়। ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান হলো দ্বীনের জ্ঞান—যা মানুষকে আল্লাহকে চেনায়, সঠিক-ভুলের পার্থক্য বোঝায় এবং চিরস্থায়ী মুক্তির পথ দেখায়। এজন্যই মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিদের জন্য যে দোয়া করতেন, তার একটি হলো—“আল্লাহুম্মা ফাক্কিহু ফিদ্দিন।” অর্থাৎ, “হে আল্লাহ, তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দাও।”
হাদিসে বর্ণিত আছে—মহানবী (সা.) ছোট শিশু ইবন আব্বাস (রা.)-কে বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করেছিলেন: “আল্লাহুম্মা ফাক্কিহ্হু ফিদ্দিন, ওয়া আল্লিম্হু আত্-তাওইল”। অর্থাৎ “হে আল্লাহ, তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দাও এবং কোরআনের ব্যাখ্যা শিক্ষা দাও।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৪৭৭)
এই দোয়ার বরকতেই ইবন আব্বাস (রা.) ‘তর্জুমানুল কোরআন’—অর্থাৎ কোরআনের মহান ব্যাখ্যাকারক হিসেবে পরিচিত হন।
‘ফিকহ ফিদ্দিন’ বলতে বোঝায় শুধু কিছু হালাল-হারাম জানা নয়; বরং—
আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করা
ঈমানের দৃঢ়তা অর্জন
ইবাদত ও আখলাকের মর্ম বোঝা
সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা
মহানবী (সা.) বলেছেন: “যার প্রতি আল্লাহ কল্যাণ চান, তাঁকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭১; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০৩৭)
অর্থাৎ দ্বীনের জ্ঞান পাওয়া মানেই আল্লাহর বিশেষ রহমতের নিদর্শন।
কোরআনে জ্ঞানের মর্যাদা ও প্রয়োজনীয়তা বহু স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে।
১. “বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না—তারা কি সমান?” (সুরা যুমার, আয়াত: ৯)
ইবন কাসীর এ আয়াতের তাফসিরে বলেন—আল্লাহ এখানে স্পষ্ট করেছেন যে, প্রকৃত মর্যাদা তাদেরই যারা জ্ঞান রাখে, বিশেষত দ্বীনের জ্ঞান। কারণ দ্বীনের গভীরতা মানুষকে সত্যিকার অর্থে আলোকিত করে। (তাফসির ইবন কাসির, ভলিউম ৬, পৃ. ২৩১, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, বৈরুত, ১৯৯৮)
২. “আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা উন্নত করবেন।” (সুরা মুজাদালা, আয়াত: ১১)
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, জ্ঞান কেবল দুনিয়াবি সুবিধার জন্য নয়; বরং আখিরাতেও এটি মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।
‘আল্লাহুম্মা ফাক্কিহ্হু ফিদ্দিন’ দোয়ার ভেতরে রয়েছে অসাধারণ শিক্ষা—
১. শিশুশিক্ষার প্রতি গুরুত্ব: নবী (সা.) ইবন আব্বাস (রা.)-এর শৈশবেই এ দোয়া করেছেন। এর মাধ্যমে বোঝা যায়—দ্বীনের শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই শুরু হওয়া জরুরি।
২. অভিভাবকদের দায়িত্ব: সন্তানের জন্য কেবল দুনিয়ার সফলতা নয়, দ্বীনের বোধগম্যতার দোয়া করা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
৩. জ্ঞান ছাড়া আমল অন্ধকার: কোরআন-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান ছাড়া ইবাদত বা আমল সঠিক হতে পারে না। এজন্য নবী (সা.) আমলের আগে জ্ঞান অর্জনের কথা জোর দিয়েছেন।
৪. আল্লাহর কাছে প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তা: শুধু পড়াশোনা করলেই জ্ঞান আসবে না; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েত না এলে জ্ঞান হৃদয়ে প্রোথিত হয় না। এ কারণেই দোয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
তবে ‘আল্লাহুম্মা ফাক্কিহ্হু ফিদ্দিন’—এ দোয়া শুধু ইবন আব্বাস (রা.)-এর জন্য নয়; বরং এটি প্রতিটি মুসলমানের জন্য পথনির্দেশ। যে ব্যক্তি দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করে, তার জীবন হয় আলো-ঝলমলে, তার আমল হয় সঠিক, আর সমাজ হয় আলোকিত। তাই আমাদের সবার উচিত এই দোয়া বেশি বেশি করা—নিজের জন্য, সন্তানদের জন্য, এবং গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য।