তুঘরা প্রতীক, তুর্কিয়ে
তুঘরা প্রতীক, তুর্কিয়ে

ইসলামি শিল্পকলা যেভাবে গড়ে উঠল

ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময়ে শিল্পের জন্য শিল্প নামক ধারণা প্রচলিত হয়েছিল, যা শিল্পকে কেবল নান্দনিকতার জন্য বিবেচনা করত। কিন্তু ইসলামি শিল্পকলা একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, যার মূলমন্ত্র ছিল, জীবনের সেবায় শিল্প।

এই শিল্প কেবল নান্দনিকতার জন্য নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য সৃষ্ট। এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়ে ঘরবাড়ি, আসবাব, পাত্র-কুপাত্র এবং জীবনের প্রতিটি দিককে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। ইসলামি শিল্পের এই বৈশিষ্ট্যই এটিকে বিশ্বব্যাপী অনন্য এবং প্রভাবশালী করে তুলেছে।

ইসলামি শিল্পকলা একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা এর ঐক্য এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে নিহিত। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামি শিল্পের বিভিন্ন শৈলী বা তরজ গড়ে উঠেছে, তবু এর মধ্যে একটি সাধারণ ঐক্য রয়েছে, যা ইসলামি সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ।

ইসলামি শিল্পকলা একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, যার মূলমন্ত্র ছিল, জীবনের সেবায় শিল্প। এই শিল্প কেবল নান্দনিকতার জন্য নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য সৃষ্ট।

ইসলামি শিল্পের বৈশিষ্ট্য

ইসলামি শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর জীবনমুখী প্রকৃতি। এটি কেবল দৃষ্টিনন্দন নয়, বরং ব্যবহারিক। এটি স্থাপত্য, গৃহসজ্জা, পাত্র নির্মাণ, বস্ত্রশিল্প এবং এমনকি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জিনিসপত্রে প্রয়োগ হয়েছে। ইসলামি শিল্পের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এর ঐক্য। যদিও বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন শৈলী গড়ে উঠেছে, তবু সব শৈলীতে ইসলামি সভ্যতার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এই ঐক্য ইসলামি শিল্পের শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান কারণ।

ইসলামি শিল্পে জ্যামিতিক নকশা, উদ্ভিদজাত অলংকরণ এবং ক্যালিগ্রাফি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এই উপাদানগুলো শিল্পকে শুধু সুন্দরই করেনি, বরং আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। কোরআনের আয়াত বা হাদিসের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে ব্যবহৃত হয়ে এটিকে ধর্মীয় তাৎপর্য প্রদান করেছে।

১৩ শতকের মুসতানিসিরিয়া মাদরাসার একটি দেয়াল

উমাইয়া শৈলী

ইসলামি শিল্পের প্রথম শৈলী হলো উমাইয়া শৈলী, যা উমাইয়া খিলাফতের সময়ে (৬৬১-৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) গড়ে ওঠে। এই শৈলী দামেস্ককে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়, যা তখন ইসলামি বিশ্বের রাজধানী ছিল। উমাইয়া শিল্প স্থানীয় বাইজান্টাইন ও সাসানীয় শিল্পের প্রভাবে গড়ে উঠেছিল। এই শৈলীতে বাইজান্টাইন শিল্পের প্রভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের নকশা এবং সাসানীয় শিল্পের প্রভাবে জ্যামিতিক নকশা ও প্রতিসম প্রাণিজ নকশা (যেমন জীবনের গাছের মাঝে দুটি প্রাণী) দেখা যায়।

উমাইয়া শৈলীর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ, যেখানে জটিল মোজাইক এবং উদ্ভিদজাত নকশা ব্যবহৃত হয়েছে। এই শৈলী একটি সেতু হিসেবে কাজ করেছিল, যা খ্রিষ্টান শিল্প থেকে ইসলামি শিল্পে রূপান্তরের পথ সুগম করেছিল। এটি প্রমাণ করে যে ইসলামি শিল্প শুরু থেকেই স্থানীয় শিল্পের সঙ্গে মিশে নতুন রূপ গ্রহণ করতে সক্ষম ছিল।

মুঘল স্থাপত্যের একটি নান্দনিক শৈলী, দিল্লী, ভারত

আব্বাসীয় শৈলী

আব্বাসীয় খিলাফতের (৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে) উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামি শিল্পে একটি নতুন শৈলী গড়ে ওঠে, যা আব্বাসীয় শৈলী নামে পরিচিত। এই শৈলী বাগদাদ ও সামারাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়। সাসানীয় শিল্পের প্রভাব এই শৈলীতে প্রকট ছিল, বিশেষ করে জ্যামিতিক নকশা এবং ধাতব বর্ণের পাত্র নির্মাণে।

আব্বাসীয় শৈলীতে ধাতব বর্ণের খৈ (লাস্টারযুক্ত পাত্র) উল্লেখযোগ্য ছিল, যা সোনা ও রুপার পাত্রের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ইসলামে অতিরিক্ত বিলাসিতা নিষিদ্ধ হওয়ায় এ ধরনের পাত্র জনপ্রিয় হয়। এ ছাড়া জিপসাম বা প্লাস্টারের ব্যবহার এই শৈলীতে বিশেষভাবে প্রকাশ পায়। সামারায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে এই শৈলীর অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে, যা ৯ম শতাব্দীতে এই শৈলীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।

আব্বাসীয় শৈলীতে তির্যক খোদাই পদ্ধতি অনন্য ছিল, যা কাঠ ও জিপসামে ব্যবহৃত হতো। এই শৈলীতে জ্যামিতিক নকশা, সর্পিল রেখা এবং বড় আকারের অলংকরণ প্রাধান্য পেয়েছে, যা প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি সংযোগের পরিবর্তে শৈল্পিক রূপান্তরের ওপর জোর দেয়।

ইমাম হোসাইন মসজিদের প্রবেশ পথ, ইরাক

ইরানি শৈলী

ইরান ইসলামি শিল্পের ক্ষেত্রে সব সময়ই অগ্রগণ্য ছিল। সেলজুক আমল (এগারো শতক) থেকে ইরানি শৈলী বা সেলজুক শৈলী গড়ে ওঠে, যা জ্যামিতিক নকশা এবং কুফি লিপির ব্যবহারে বিশেষভাবে পরিচিত। খোরাসান ও হেরাত এই শৈলীর কেন্দ্র ছিল, যেখানে তামা, ব্রোঞ্জ এবং রুপায় মোড়া পাত্র নির্মিত হতো। এই শৈলীতে উদ্ভিদজাত নকশা এবং জীবজন্তুর চিত্রাঙ্কন প্রচলিত ছিল।

পরবর্তীকালে সাফাভি আমলে (১৬-১৭ শতক) ইরানি শিল্প আরও উন্নত হয়। এ সময়ে মুখপত্র (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) তৈরি, স্বর্ণ ও রৌপ্য রঙের ব্যবহার এবং জটিল জ্যামিতিক নকশা উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। সাফাভি আমলের সজ্জিত গালিচা এবং খৈ পাত্র বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত। এই শৈলী ইরানের প্রাচীন শিল্পকলার সঙ্গে ইসলামি শিল্পের মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি অনন্য রূপ পায়।

পুত্রা মসজিদের গম্বুজ, মালয়েশিয়া

ফাতেমীয় শৈলী

ফাতেমীয় আমল (৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে) মিসর ও সিরিয়ায় ইসলামি শিল্পের একটি স্বর্ণযুগ ছিল। ফাতেমীয় শৈলী চিত্রকলা, খৈ, কাচের পাত্র এবং বস্ত্রশিল্পে বিশেষভাবে উন্নত ছিল। এই শৈলীতে মানুষ ও প্রাণিজ চিত্রাঙ্কন বেশি প্রচলিত ছিল, যা পূর্ববর্তী শৈলীগুলোর তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। ফাতেমীয় আমলের কাচের পাত্র ধাতব বর্ণে সজ্জিত ছিল, যা এই শৈলীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ, কায়রোর ফাতেমীয় হাম্মামের দেয়ালে জিপসামে খোদিত নকশা এই শৈলীর দক্ষতার প্রমাণ।

ফাতেমীয় বস্ত্রশিল্পে কুফি লিপি এবং উদ্ভিদজাত নকশার ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এই শৈলীতে কাঠের কাজও উন্নত ছিল, যেমন সৈয়্যিদা রুকাইয়ার মিহরাব এবং বিশাল দরজাগুলোয় মানুষ, প্রাণী ও পাখির চিত্রাঙ্কন দেখা যায়। এই শৈলী ইসলামি শিল্পের বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

প্রাচীন মামলুক আমলের একটি পাণ্ডুলিপির চিত্র

মামলুক শৈলী

মামলুক আমল (১২৪০-১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ) মিসরের ইসলামি শিল্পের আরেকটি স্বর্ণযুগ। মামলুক শৈলী ধাতব কাজ, বিশেষ করে সোনা ও রুপায় মোড়া তামার পাত্র, দরজা, চেয়ার, বাক্স এবং কলমদানিতে বিশেষভাবে উন্নত ছিল। এই শৈলীতে নস্‌খি লিপি ব্যবহার করে সুলতানদের নাম ও উপাধি খোদাই করা হতো। মামলুক আমলের কাচের মশকাত (ল্যাম্প) মিনাকারির ব্যবহারে বিখ্যাত ছিল।

মামলুক শিল্পে মার্বেল ফ্লোরিংয়ে ফসাইক কাজ এবং কাঠের জালি (মাশরাবিয়া) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মসজিদের মিহরাব ও মিনবরে এই নকশাগুলো ব্যবহৃত হতো। মামলুক মুখপত্রগুলো নস্‌খি লিপিতে লেখা হতো এবং সুলতানদের নামে উৎসর্গ করা হতো, যা এই শৈলীর ধর্মীয় ও শৈল্পিক গুরুত্ব প্রকাশ করে।

কাসাব্লাঙ্কা, মরোক্কো। মাগরিবি শৈলীর অনন্য উদাহরণ

মাগরিবি শৈলী

মাগরিবি শৈলী আন্দালুসিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় মুয়াহিদ আমলে (১২ শতক) বিকশিত হয়। এই শৈলীর কেন্দ্র ছিল গ্রানাডার আলহাম্বরা প্রাসাদ, যা ১৪ শতকে নির্মিত হয়। এই শৈলীতে জিপসামে খোদিত জটিল নকশা, মুকারনাস এবং কুফি লিপির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। মগরিবি শৈলীতে বইয়ের বাঁধাই এবং চামড়ার কাজও উন্নত ছিল। খৈশিল্পে ধাতব বর্ণের ব্যবহার এই শৈলীকে মামলুক শৈলীর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ করে তুলেছে।

তুরস্কের হাগিয়া সুফিয়ার একটি খিলানে ইসলামের তৃতীয় খলিফ হজরত উসমানের নাম লেখা

তুর্কি শৈলী

উসমানীয় আমলে (১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে) তুর্কি শৈলী গড়ে ওঠে। এই শৈলীতে খৈ, টাইলস, গালিচা, রেশমি কাপড় এবং মুখপত্র বিশেষভাবে উন্নত ছিল। তুর্কি গালিচা, বিশেষ করে নামাজের গালিচা, জ্যামিতিক নকশা এবং মিহরাবের চিত্রাঙ্কনে বিখ্যাত। তুর্কি খৈয়ে ফুল ও উদ্ভিদের নকশা প্রাধান্য পেয়েছে, যা এই শৈলীকে একটি স্বতন্ত্র রূপ দিয়েছে।

ভারতীয় শৈলী

ভারতীয় শৈলী মোগল আমলে (১৬ শতক থেকে) বিকশিত হয়। এই শৈলী ইরানি শিল্পের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, তবে এর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মোগল স্থাপত্যে পারস্যের খিলান, নলাকার মিনার এবং বাল্বের মতো গম্বুজ ব্যবহৃত হয়েছে। চিত্রকলায় শান্ত রঙের ব্যবহার এবং প্রকৃতির সঙ্গে সাদৃশ্য এই শৈলীকে অনন্য করেছে। তাজমহল এই শৈলীর একটি অসাধারণ উদাহরণ।

সিন্ধ, পাকিস্তান। ভারতীয় শৈলীর একটি চিত্র

সারকথা

ইসলামি শিল্পকলা কেবল নান্দনিকতার জন্য নয়, বরং জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। উমাইয়া থেকে ভারতীয় শৈলী পর্যন্ত প্রতিটি শৈলী ইসলামি সভ্যতার সাধারণ ঐক্যের মধ্যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছে।

এই শিল্প জ্যামিতিক নকশা, উদ্ভিদজাত অলংকরণ এবং ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে। ইসলামি শিল্প আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি কেবল সৌন্দর্য নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উপযোগিতা ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় ঘটিয়েছে।

সূত্র: ইসলাম অনলাইন ডটকম