
সপ্তম শতাব্দীতে মক্কায় যখন মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর বাণী প্রচার শুরু করলেন, তখন কোরাইশ নেতারা একে স্তব্ধ করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও উপহাসের আশ্রয় নিয়েছিল। তারা কেবল সত্যকে অস্বীকারই করেনি, বরং আল্লাহর নবীজির ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর ওপর অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ কোরআনকে নিয়ে চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছিল।
মক্কার সেই উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপটেই সুরা হিজরের প্রথম দিকের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়, যেখানে একদিকে কাফেরদের বিদ্রূপের চিত্র ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে কেয়ামত পর্যন্ত কোরআন অবিকৃত থাকার এক মহাজাগতিক সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে।
মক্কার কাফেররা আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত। সুরা হিজরের ৬ নম্বর আয়াতে তাদের সেই আচরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলে, হে ওই ব্যক্তি, যার ওপর ‘জিকির’ (কোরআন) অবতীর্ণ হয়েছে, তুমি তো নিশ্চয়ই একজন উন্মাদ।’ (সুরা হিজর, আয়াত: ৬)
এখানে লক্ষণীয় যে, তারা ‘যার ওপর কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে’ বলে সম্বোধন করেছিল ঠিকই, কিন্তু তা বিশ্বাসের জায়গা থেকে নয়, বরং উপহাস বা ব্যঙ্গ করার ছলে। তারা বিশ্বাসই করত না যে মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর কোনো ঐশী বাণী নাজিল হতে পারে।
প্রখ্যাত মুফাসসির মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের বর্ণনা অনুযায়ী, এই ধৃষ্টতাপূর্ণ কথাগুলো বলেছিল মূলত আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া, নজর ইবনে হারিস, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ এবং ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার মতো কোরাইশ নেতারা। (আল-জামি লি আহকামিল কুরআন, ১০/৫, দারুল কুতুব আল-মিসরিয়্যাহ, কায়রো, ১৯৬৪)
তাদের যুক্তি ছিল—যা আমাদের বিচারবুদ্ধিতে ধরে না, তা নিশ্চয়ই কোনো সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না। অথচ তারা ভুলেই গিয়েছিল যে এই মানুষটিকেই তারা কয়েক বছর আগে ‘আল-আমিন’ বা পরম বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
কাফেররা কেন তাঁকে ‘মাজনুন’ বা উন্মাদ বলেছিল? এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আল্লামা ইবনে আশুর তাঁর তাফসির গ্রন্থে লিখেছেন, রাসুল (সা.) যখন ওহি নাজিল হওয়ার দাবি করতেন, তখন তাদের সংকীর্ণ বুদ্ধি তা গ্রহণ করতে পারত না।
তারা ভাবত, একজন সাধারণ মানুষের কাছে অদৃশ্য জগত থেকে সংবাদ আসা অসম্ভব। তাই তারা নিজেদের অজ্ঞতাকে আড়াল করতে রাসুল (সা.)-এর বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলত। (আত-তাহরির ওয়াত-তানভির, ৪/৯, দারু সুহনুন, তিউনিসিয়া, ১৯৮৪)
তাদের যুক্তি ছিল—যা আমাদের বিচারবুদ্ধিতে ধরে না, তা নিশ্চয়ই কোনো সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না। অথচ তারা ভুলেই গিয়েছিল যে এই মানুষটিকেই তারা কয়েক বছর আগে ‘আল-আমিন’ বা পরম বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
উপহাসের পরবর্তী ধাপে তারা রাসুল (সা.)-এর কাছে অলৌকিক প্রমাণের দাবি তুলল। তারা বলল, ‘তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তবে আমাদের কাছে ফেরেশতাদের নিয়ে আসো না কেন?’ (সুরা হিজর, আয়াত: ৭)
এটি ছিল মূলত একটি ‘চ্যালেঞ্জিং’ ভঙ্গি, যা সত্য অন্বেষণের জন্য নয় বরং নবীজিকে অপদস্থ করার জন্য করা হয়েছিল। ইমাম আলুসি তাঁর রুহুল মাআনি তফসির গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এই আয়াতের মাধ্যমে তাদের চরম আদবহীনতা ও অহংকার প্রকাশ পেয়েছে। তারা স্রষ্টার নিয়মকে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো চালাতে চেয়েছিল। (রুহুল মাআনি, ৭/২৭৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০১)
মক্কার মুশরিকদের এই ধৃষ্টতাপূর্ণ দাবির জবাবে আল্লাহ তাআলা তিনটি অকাট্য যুক্তি পেশ করেন।
১. ফেরেশতা অবতরণের নীতিমালা: আল্লাহ বলেন, ‘আমি ফেরেশতাদের একমাত্র সত্য ও যৌক্তিক কারণেই অবতীর্ণ করি।’ (সুরা হিজর, আয়াত: ৮)
অর্থাৎ, মানুষের তামাশা দেখার জন্য ফেরেশতা নাজিল করা আল্লাহর সুন্নত বা নিয়ম নয়।
২. অবিলম্ব আজাবের হুঁশিয়ারি: আল্লাহ আরও বলেন, ফেরেশতারা যদি তাদের সামনে চাক্ষুষ হাজির হতো এবং তারা এরপরও ইমান না আনত, তবে তাদের আর কোনো সময় দেওয়া হতো না; বরং তাৎক্ষণিক ধ্বংস করে দেওয়া হতো। আল্লাহ তাদের অবকাশ দিয়েছিলেন বলেই তখন ফেরেশতা পাঠাননি।
এই বিষয়টি সুরা আনআমেও বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা বলে, তার ওপর কোনো ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন? যদি আমি ফেরেশতা অবতীর্ণ করতাম, তবে ফয়সালা হয়েই যেত, এরপর তাদের আর কোনো অবকাশ দেওয়া হতো না।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৮)
৩. কোরআন সংরক্ষণের চিরন্তন ঘোষণা: কাফেরদের উপহাসের চূড়ান্ত জবাব হিসেবে আল্লাহ সেই যুগান্তকারী ঘোষণা দিলেন, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা।
নিশ্চয়ই আমিই এই জিকির (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক।কোরআন , সুরা হিজর, আয়াত: ৯
সুরা হিজরের ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আমিই এই জিকির (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক।’ (সুরা হিজর, আয়াত: ৯)
এই একটি মাত্র আয়াতে আল্লাহ তাআলা কোরআনের বিশুদ্ধতা নিয়ে যাবতীয় সংশয় চিরতরে মিটিয়ে দিয়েছেন। এখানে ‘জিকির’ শব্দ দিয়ে কোরআনকে বোঝানো হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য এক মহান স্মারক ও উপদেশ।
আল্লাহ তাআলা কেবল সংরক্ষণের ওয়াদা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং মানব ইতিহাসে এমন কিছু প্রক্রিয়া জারি করেছেন যার মাধ্যমে এই কিতাব অবিকৃত রয়েছে। এর প্রধান কয়েকটি দিক হলো:
বিকৃতি থেকে সুরক্ষা: পৃথিবীর কোনো শক্তির পক্ষে কুরআনের একটি হরফ বা নুকতা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তৌরাত বা ইঞ্জিলের মতো মানুষের হস্তক্ষেপে এর মূল বাণী হারিয়ে যায়নি।
মুখস্থ করার অলৌকিক ক্ষমতা: আল্লাহ এই কিতাবকে মানুষের স্মৃতির জন্য সহজ করে দিয়েছেন। প্রতিটি যুগে অসংখ্য ‘হাফেজ’ বা মুখস্থকারী তৈরি হওয়া কোরআনের এক জীবন্ত মোজেজা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে কোরআন শেখে এবং অন্যকে তা শেখায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,০২৭)
হাফেজদের কারণেই কোরআনের কোনো কপিতে ভুল ছাপা হলে তা তৎক্ষণাৎ ধরা পড়ে যায়।
ভাষা ও শৈলী রক্ষা: কোরআনের আরবি ভাষা ও এর ব্যাকরণিক মান আজও সেই ১৪০০ বছর আগের মতোই অক্ষুণ্ণ রয়েছে। পৃথিবীতে এমন দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ নেই যেখানে একটি ভাষা ও তার সাহিত্য হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত আছে।
ফলে যুগে যুগে ইসলামের চরম শত্রুরাও কোরআনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ক্রুসেড থেকে শুরু করে আধুনিক প্রাচ্যবিদদের আক্রমণ—সবই এই কিতাবের বজ্রকঠিন দেয়ালের সামনে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
আব্বাসীয় যুগে বা মঙ্গোল আক্রমণের সময় মুসলিমরা রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে চরম দুর্বল হয়ে পড়লেও কোরআনের একটি আয়াতও কেউ বদলাতে পারেনি। এমনকি ইসলামের নামধারী বিভিন্ন বিভ্রান্ত দলও নিজেদের স্বার্থে হাদিস জাল করার চেষ্টা করলেও কুরআনের মধ্যে কিছু ঢোকানোর সাহস পায়নি।
বিখ্যাত পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক ইবনে কুতায়বা তাঁর তাবিলু মুশকিলিল কুরআন গ্রন্থে লিখেছেন যে, কোরআন যদি মানুষের রচনা হতো তবে এর মধ্যে অবশ্যই বৈপরীত্য ও অসংলগ্নতা থাকত। কিন্তু আল্লাহর কুদরতি সংরক্ষণের ফলে এটি আজও বিশ্বের সবচেয়ে পঠিত ও নির্ভুল গ্রন্থ। (পৃষ্ঠা: ১২, দারুত তুরাস, কায়রো, ১৯৭৩)