একটি বিশাল মহিরুহের কথা কল্পনা করা যাক, যার শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত আর ডালপালাগুলো আকাশের দিকে বিস্তৃত। একটি পরিবারে দাদা-দাদি বা নানা-নানি হলেন সেই শিকড়, আর নাতি-নাতনিরা হলো সেই ডালপালায় প্রস্ফুটিত নতুন কুঁড়ি। জীবনের দুই ভিন্ন মেরুর এই মিলন এক অপূর্ব নান্দনিকতার সৃষ্টি করে।
প্রবীণের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রজ্ঞা আর নবীনের নিষ্কলুষ চঞ্চলতা যখন এক বিন্দুতে মিলিত হয়, তখন সেখানে জন্ম নেয় নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক অনন্য জগত। এ সম্পর্ক কেবল রক্তের টান নয়; বরং এটি একটি আত্মিক সেতুবন্ধন, যা একটি প্রজন্মকে অন্য প্রজন্মের সঙ্গে গেঁথে রাখে।
দাদা-দাদি ও নাতি-নাতনির সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর নিঃশর্ত প্রকৃতি। মা-বাবার শাসনে যেখানে অনেক সময় কঠোরতা থাকে, দাদা-দাদির আঁচল সেখানে সব সময়ই আশ্রয়ের কোমল পরশ হয়ে থাকে। এখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই, নেই কোনো জাগতিক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা।
সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না।সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৯৪৩
শিশুরা যখন তাদের দাদা-দাদির কাছে যায়, তখন তারা কেবল একজন মানুষকে পায় না; বরং এমন এক সত্তাকে পায় যার কাছে তাদের হাজারো আবদার ও বায়না সাদরে গৃহীত হয়।
এ সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্থনি গিডেন্স তাঁর সোশিওলজি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে আধুনিক পরিবারব্যবস্থায় প্রবীণেরা শিশুদের জন্য একধরনের ‘আবেগময় নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করেন, যা তাদের মানসিক বিকাশে অপরিহার্য। (সোশিওলজি, ষষ্ঠ সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ৩১৫, পলিটি প্রেস, কেমব্রিজ, ২০০৯)
শিশুদের সান্নিধ্য প্রবীণদের জীবনে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। বার্ধক্যের যে একঘেয়েমি বা নিঃসঙ্গতা অনেক সময় তাদের গ্রাস করতে চায়, নাতি-নাতনিদের কলকাকলি তা মুহূর্তেই দূর করে দেয়। ছোট শিশুদের অযৌক্তিক প্রশ্ন, তাদের আধো আধো বুলি আর চঞ্চলতা দাদা-দাদিদের মনে করিয়ে দেয় যে জীবন ফুরিয়ে যায়নি; বরং তা নতুন রূপে প্রবাহিত হচ্ছে।
অন্যদিকে শিশুরা তাদের দাদা-দাদির কাছ থেকে পায় জীবনের এমন সব শিক্ষা, যা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া সম্ভব নয়। তারা শেখে ধৈর্য, শেখে সহমর্মিতা এবং শেখে নিজেদের ঐতিহ্যকে সম্মান করতে।
ইসলামি জীবনদর্শনে বড়দের সম্মান ও ছোটদের প্রতি স্নেহের এ ভারসাম্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৯৪৩)
এ হাদিস পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার এক চমৎকার রূপরেখা প্রদান করে।
একজন শিশু যখন তার দাদির কাছে রূপকথার গল্প শোনে বা দাদার কাছে পারিবারিক ঐতিহ্যের ইতিহাস শোনে, তখন তার অবচেতন মনে নিজের শিকড় সম্পর্কে একধরনের গর্ববোধ তৈরি হয়।
দাদা-দাদিরা হলেন চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বা অভিজ্ঞতার জীবন্ত ভান্ডার। তাঁদের জীবনের চড়াই-উতরাই, ভুল এবং শিক্ষাগুলো গল্পের ছলে নাতি-নাতনিদের হৃদয়ে গেঁথে যায়।
একজন শিশু যখন তার দাদির কাছে রূপকথার গল্প শোনে বা দাদার কাছে পারিবারিক ঐতিহ্যের ইতিহাস শোনে, তখন তার অবচেতন মনে নিজের শিকড় সম্পর্কে একধরনের গর্ববোধ তৈরি হয়। এটি তাকে সামাজিকভাবে সচেতন ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে।
পারিবারিক বন্ধন ও গুরুজনদের প্রতি সদ্ব্যবহার সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন যে তোমরা তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩)
এখানে পিতা-মাতা বলতে পিতামহ-পিতামহী বা মাতামহ-মাতামহীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারণ, তাঁরা বংশের আদি উৎস।
বর্তমান ডিজিটাল যুগে যখন শিশুরা স্ক্রিন আসক্তিতে ভুগছে, তখন দাদা-দাদির সান্নিধ্য তাদের জন্য ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ হিসেবে কাজ করতে পারে। তাদের সঙ্গে কাটানো সময় শিশুদের একাকিত্ব দূর করে এবং সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, যেসব শিশু তাদের দাদা-দাদির সঙ্গে বেড়ে ওঠে, তাদের মধ্যে বিষণ্নতা ও উদ্বেগের হার অনেক কম থাকে। জন কোলম্যান লিখেছেন, বয়ঃসন্ধিকালের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে প্রবীণ আত্মীয়দের অভিজ্ঞতা ও সমর্থন একটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। (দ্য নেচার অব অ্যাডোলেসেন্স, চতুর্থ সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১২০, রুটলেজ, লন্ডন, ২০১১)
অন্যদিকে নাতি-নাতনিদের সান্নিধ্য প্রবীণদের স্বাস্থ্যের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাঁদের সঙ্গে খেলাধুলা করা বা তাঁদের পেছনে ছোটাছুটি করা একধরনের শরীরচর্চা, যা তাঁদের হরমোন নিঃসরণে সহায়তা করে এবং মনের প্রফুল্লতা বজায় রাখে। এটি তাঁদের মধ্যে ‘প্রয়োজনীয় হওয়ার’ একটি অনুভূতি তৈরি করে, যা বার্ধক্যে অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমানে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে অমূল্য জীবনবোধ থেকে, আর প্রবীণেরা নিমজ্জিত হচ্ছেন একাকিত্বের অন্ধকারে।
একটি পরিবারের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাহিত হয় এই প্রবীণদের মাধ্যমেই। মা–বাবা যখন কর্মব্যস্ততায় ক্লান্ত থাকেন, তখন দাদা-দাদিরাই পরম মমতায় নাতি-নাতনিদের নৈতিক চরিত্রের ভিত্তি গড়ে দেন। তাঁরা কেবল তাঁদের বংশধরদের মধ্যে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখেন না; বরং আগামীর এক সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন বোনেন।
হাদিসে প্রবীণদের উপস্থিতিকে বরকতের কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘বরকত তোমাদের প্রবীণদের সঙ্গে থাকে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫৫৯)
এখানে প্রবীণ বলতে পরিবারের মুরব্বিদের বোঝানো হয়েছে, যাঁদের দোয়া ও উপস্থিতি পরিবারের ওপর আল্লাহর বিশেষ রহমত নিয়ে আসে।
বর্তমানে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা ও প্রবীণেরা। শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে অমূল্য জীবনবোধ থেকে, আর প্রবীণেরা নিমজ্জিত হচ্ছেন একাকিত্বের অন্ধকারে।
এ দূরত্ব ঘোচাতে হলে আমাদের পারিবারিক কাঠামোতে প্রবীণদের উপযুক্ত স্থান দিতে হবে। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে হলেও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
পবিত্র কোরআনে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন...আর ভয় করো আল্লাহকে, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের কাছে যাচনা করো এবং সতর্ক থাকো রক্ত-সম্পর্কীয় আত্মীয়তা বন্ধন অটুট রাখতে।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১)