অসিয়ত: গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিধান

ইসলামে অসিয়ত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান, রীতি-নীতি। অসিয়তের গুরুত্ব ও নিয়মকানুন নিয়ে জরুরি কিছু কথা এখানে তুলে ধরা হলো।

ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত যে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যে মুসলিম ব্যক্তির কিছু অর্থ সস্পদ রয়েছে, আর সে এ সম্পর্কে অসিয়ত করতে চায়, সেই মুসলিম ব্যক্তির জন্য সমীচীন নয় যে, সে দু’রাত অতিবাহিত করবে অথচ তার কাছে অসিয়ত লিখিত থাকবে না। (মুসলিম, হাদিস: ১,৬২৭)

অসিয়ত কী?

সহজ ভাষায়, অসিয়ত হলো নিজের মৃত্যুর পর দান-খয়রাত বা অন্য কোনো ভালো কাজে নিজ সম্পদ ব্যয়ের নির্দেশ দিয়ে যাওয়া।

শরীয়তের বিধান অনুযায়ী, যার হাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বা ওয়ারিশদের (উত্তরাধিকারীদের) জন্য বরাদ্দ সম্পদের বাইরে বাড়তি অনেক সম্পদ রয়েছে, তার জন্য অসিয়ত করা মোস্তাহাব বা পছন্দনীয়।

এর সপক্ষে মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে যে, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অর্থ-সম্পদ রেখে যায়, তবে যখন তার মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হবে, তখন নিজ পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে ন্যায়সঙ্গতভাবে অসিয়ত করবে। এটা মুত্তাকিদের অবশ্য কর্তব্য।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮০)।

অধিকাংশ আলেম ও মুফাসসিরগণের মতে, এই আয়াতে খাইর বা অর্থ-সম্পদ বলতে লোকরীতিতে যতটুকু সম্পদকে অনেক বলা হয়, তাকেই বোঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন মাত্রা নেই। (তাফসিরুস সাদি, পৃ. ৮৫)

তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অর্থ-সম্পদ রেখে যায়, তবে যখন তার মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হবে, তখন নিজ পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে ন্যায়সঙ্গতভাবে অসিয়ত করবে। এটা মুত্তাকিদের অবশ্য কর্তব্য।
কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮০

অসিয়ত কখন কেমন

অবস্থাভেদে অসিয়ত করা কখনো আবশ্যক, কখনো নিষিদ্ধ আবার কখনো অপছন্দনীয় হতে পারে।

ওয়াজিব বা আবশ্যক অসিয়ত হল, যদি কারো কাছে এমন কোনো পাওনা বা ঋণ থাকে যার লিখিত প্রমাণ নেই, অথবা যদি কারো গচ্ছিত আমানত তার কাছে থাকে, তবে সেগুলোর ব্যাপারে অসিয়ত করা বাধ্যতামূলক। ঋণ দুই রকম:

১. আল্লাহর হক: অনাদায়ী জাকাত, হজ, কাফফারা বা মানত।

২. বান্দার হক: পাওনা ঋণ, বকেয়া বিল কিংবা স্ত্রীর অনাদায়ী মোহরানা।

হারাম বা নিষিদ্ধ অসিয়ত হল, কিছু ক্ষেত্রে অসিয়ত করা ইসলামে নিষিদ্ধ। যেমন, গুনাহ বা নাজায়েজ কোনো উদ্দেশ্যে সম্পদ দান করা। সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ (১/৩)-এর বেশি পরিমাণ সম্পদ অসিয়ত করা। উত্তরাধিকারীদের মধ্য থেকে বিশেষ কাউকে সম্পদ দিয়ে দেওয়ার অসিয়ত করা।

মাকরুহ বা অপছন্দনীয় অসিয়ত হল, যদি কারো সম্পদের পরিমাণ কম হয় এবং তার ওয়ারিশরা দরিদ্র বা অভাবী হয়, তবে তার জন্য দান বা কল্যাণের কাজে অসিয়ত করা ঠিক নয়। কারণ নিজের অভাবী পরিজনদের সাহায্য করা তখন তার জন্য অধিক জরুরি।

এর স্বপক্ষে প্রমাণ হল, সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি (সা.) একবার আমাকে রোগাক্রান্ত অবস্থায় দেখতে আসেন। সে সময় আমি মক্কায় ছিলাম...

আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি কি আমার সমুদয় মালের ব্যবহারের অসিয়ত করে যাব?

তিনি বললেন, না।

আমি আরজ করলাম, তবে অর্ধেক?

তিনি বললেন, না।

আমি আরজ করলাম, তবে এক তৃতীয়াংশ?

তিনি বললেন, এক তৃতীয়াংশ হতে পারে। তবে এক তৃতীয়াংশও অনেক। ওয়ারিশদের দরিদ্র পরমুখাপেক্ষী করে রেখে যাওয়ার চেয়ে ধনী অবস্থায় রেখে যাওয়া শ্রেয়। তুমি যখনই কোনো খরচ করবে, তা সদকারূপে গণ্য হবে। এমনকি সেই লোকমাও যা তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দেবে। হয়ত আল্লাহ পাক তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং লোকেরা তোমার দ্বারা উপকৃত হবেন, আবার কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সে সময় তার একটি মাত্র কন্যা ছাড়া কেউ ছিল না। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৭৪২)

অসিয়তের মাধ্যমে একজন মুসলিম তার জীবনে করা ভুল-ত্রুটি বা ইবাদতের ঘাটতি পূরণ করার একটি সুযোগ পান। পার্থিব জীবনে যে নেক আমলগুলো তার হয়তো করা হয়ে ওঠেনি, মৃত্যুর সময় শরিয়ত তাকে তা পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

যে কাজগুলোতে অসিয়ত করা যায়

পুণ্যময় বা জনকল্যাণমূলক যেকোনো কাজেই অসিয়ত করা বৈধ। এই অসিয়তের ক্ষেত্রগুলো যত বেশি ফলপ্রসূ হবে, সওয়াবও তত বেশি হবে। যেমন:

১. মসজিদ নির্মাণ।

২. অসহায়-দরিদ্রদের আর্থিক সহায়তা।

৩. অভাবগ্রস্ত আত্মীয়স্বজনের জন্য সম্পদ রাখা।

৪. ওয়াকফ সম্পত্তি করা।

৫. দ্বীন প্রচার বা দাওয়াতি কাজ।

৬. শিক্ষকদের বেতন, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি ও কল্যণকর বই প্রকাশে সহায়তা করা।

৭. জিহাদে আর্থিক সহায়তা।

৮. ইসলামি প্রচার মাধ্যম বা ইন্টারনেটে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া।

৯. সামাজিক ও ধর্মীয় কল্যাণে কাজ করে এমন বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিগত গবেষণা।

১০. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির দেনা পরিশোধ বা বন্দীদের কারামুক্তিতে সাহায্য করা।

অসিয়ত কেন জরুরি

  • এর মাধ্যমে মানুষের মৃত্যুর পর তার নেক আমলের সওয়াব জারি থাকে। যখন নেকির খুব প্রয়োজন হবে, তখন এটি তার আমলনামায় পৌঁছাতে থাকবে।

  • এর মাধ্যমে সৎ কাজ ও কল্যাণ সমাজময় ছড়িয়ে পড়ে। কারণ শরীয়ত অনুযায়ী ভালো কাজ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে অসিয়ত হয় না।

  • এর মাধ্যমে একজন মুসলিম তার জীবনে করা ভুল-ত্রুটি বা ইবাদতের ঘাটতি পূরণ করার একটি সুযোগ পান। পার্থিব জীবনে যে নেক আমলগুলো তার হয়তো করা হয়ে ওঠেনি, মৃত্যুর সময় শরিয়ত তাকে তা পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

সম্পদের কতটুকু অসিয়ত করা যায়

মোট সম্পদের সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) পরিমাণ অসিয়ত করা বৈধ, এর বেশি নয়। কেউ যদি এক-তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করে যায়, তবে বাড়তি অংশটুকু কার্যকর হবে না; তবে মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীরা স্বেচ্ছায় তাতে সম্মতি দিলে সেটা ভিন্ন কথা। কারণ এটি তাদের অধিকার, তারা চাইলে তা ছেড়ে দিতে পারে।

অসিয়তের পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশের চেয়ে কিছুটা কমিয়ে আনা মোস্তাহাব বা উত্তম। যেহেতু আল্লাহর রাসুল (সা.) এক-তৃতীয়াংশকে ‘অনেক’ বলে উল্লেখ করেছেন, তাই আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলতেন, ‘মানুষ যদি এক-তৃতীয়াংশ থেকে কমিয়ে এক-চতুর্থাংশ (১/৪) অসিয়ত করত, তবে কতই না ভালো হতো!’ (মুসলিম, হাদিস: ১,৬২৯)

যদি কোনো ব্যক্তির এমন কেউ না থাকে যে তার ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী হতে পারে, তবে তিনি চাইলে তার পুরো সম্পদ বা এক-তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করতে পারেন। কারণ ওয়ারিশদের হকের স্বার্থেই অসিয়তের সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, যেহেতু সেখানে কোনো ওয়ারিশ নেই, তাই সেই সীমাবদ্ধতা আর থাকছে না।

নিকটাত্মীয়দের জন্য অসিয়ত

যেই আত্মীয়রা উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো সম্পদ পায় না, তাদের জন্য অসিয়ত করা একটি সওয়াবের কাজ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যারা ইতিমধ্যে উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পদের অংশ পাবে, তাদের জন্য আলাদাভাবে কোনো অসিয়ত করা বৈধ নয়।

বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহর রাসুল (সা.) এই বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকের প্রাপ্য হক তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং কোনো উত্তরাধিকারীর (ওয়ারিশ) অনুকূলে আলাদা কোনো অসিয়ত করা যাবে না।’ (মুসনাদে আহমদ: ৫/২৬৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,৭৮০)

অসিয়ত করার কোনো সুনির্দিষ্ট সময় নেই। সুস্থ বা অসুস্থ যে কোনো অবস্থায় সারাজীবন অসিয়ত করা যায়। তবে মৃত্যুশয্যায় থাকাকালীন অসিয়তের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।

অসিয়ত যেভাবে প্রমাণিত হয়

কোনো ব্যক্তির অসিয়ত কার্যকর হতে হলে তা নিম্নলিখিত উপায়ে প্রমাণিত হতে হবে:

ক. অন্তত দুজন নির্ভরযোগ্য (ন্যায়পরায়ণ) সাক্ষীর সাক্ষ্য।

খ. অসিয়তকারীর নিজ হাতে লেখা স্পষ্ট ও চেনা অসিয়তনামা।

গ. উত্তরাধিকারীদের স্বীকৃতি। যদি কিছু উত্তরাধিকারী অসিয়তের বিষয়টি স্বীকার করে এবং অন্য কেউ অস্বীকার করে, তবে যারা স্বীকার করেছে কেবল তাদের প্রাপ্য অংশ থেকে আনুপাতিক হারে অসিয়ত কার্যকর হবে; যারা অস্বীকার করেছে তাদের ওপর এর দায় বর্তাবে না।

অসিয়ত করার সময়

অসিয়ত করার কোনো সুনির্দিষ্ট সময় নেই। সুস্থ বা অসুস্থ যে কোনো অবস্থায় সারাজীবন অসিয়ত করা যায়। তবে মৃত্যুশয্যায় থাকাকালীন অসিয়তের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।

অসিয়তকারীর মৃত্যুর পর থেকে অসিয়ত একটি আবশ্যিক আইনি বিধানে পরিণত হয়। মৃতের উত্তরাধিকারী বা সম্পদ দেখাশোনার দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের প্রধান কর্তব্য হলো কালক্ষেপণ না করে দ্রুত অসিয়ত বাস্তবায়ন করা। প্রশাসনিক বা দাপ্তরিক কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে বা সম্পদ বণ্টনের প্রয়োজনীয় হিসেব-নিকেশ করতে যতটুকু সময়ের প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি বিলম্ব করা বৈধ নয়।

অসিয়ত পরিবর্তন বা প্রত্যাহার

অসিয়তকারী তাঁর জীবিত অবস্থায় যেকোনো সময় তাঁর অসিয়ত পরিবর্তন করতে পারেন অথবা চাইলে তা সম্পূর্ণ বাতিলও করে দিতে পারেন—তা অসিয়তটি মৌখিক হোক, হাতে লেখা হোক বা আদালতের মাধ্যমে হোক। কারণ অসিয়ত কেবল মৃত্যুর পরই কার্যকর হয়। তবে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য রাখা বা দাপ্তরিক নথিতে সংশোধন করে নেওয়া উত্তম, যাতে ভবিষ্যতে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি না হয়।

অসিয়তকারী যে নেক কাজের কথা লিখে গেছেন, তার বাইরে নিজেদের খুশিমতো অসিয়ত পরিবর্তন বা রদবদল করার অধিকার উত্তরাধিকারীদের নেই। তবে অসিয়তে যদি শরিয়ত বিরোধী বা গুনাহের কোনো কথা থাকে, তবে তা বাস্তবায়ন করা যাবে না।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি সে অসিয়ত শোনার পর তাতে কোনও রদ-বদল করবে, তার গুনাহ তাদের ওপরই বর্তাবে যারা তাতে রদ-বদল করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ (সবকিছু) শোনেন ও জানেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮১)

abdullahalbaqi00@gmail.com

আবদুল্লাহিল বাকি : আলেম, লেখক ও সফটওয়্যার প্রকৌশলী