আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি ও প্রকৃতির মধ্যে এমন অপূর্ব প্রজ্ঞা রেখেছেন যে বছরের সব ঋতুই মানুষের জন্য বিশেষ উপকার বয়ে আনে। গ্রীষ্মের তীব্র তাপ, শীতের ঠান্ডা বা মাঝামাঝি আবহাওয়া—প্রতিটি ঋতুতে আল্লাহর হিকমত রয়েছে। যিনি এই প্রজ্ঞা বোঝেন, তিনি গ্রীষ্মকে শীতে বা শীতকে গ্রীষ্মে রূপান্তরিত করতে চান না; বরং প্রতিটি ঋতুকে তার উপকারিতার সঙ্গে গ্রহণ করেন।
গ্রীষ্মের তাপ ও শীতের শৈত্য মানুষের শরীরের জন্য উপকারী, কিন্তু অজ্ঞতার কারণে অনেকে এর সঠিক ব্যবহার জানেন না। এই সময়ে আমাদের পথপ্রদর্শক হলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.), তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখি কীভাবে তাপের মধ্যে স্বাস্থ্য ও আধ্যাত্মিকতার ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।
প্রাচীন চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে, মানুষের শরীরে চারটি উপাদান (আখলাত) রয়েছে: রক্ত (গরম ও আর্দ্র), পিত্ত (গরম ও শুষ্ক), কফ (ঠান্ডা ও আর্দ্র) এবং শ্লেষ্মা (ঠান্ডা ও শুষ্ক)। গরমকালে তাপ বা ঠান্ডাকালের শীত এই উপাদানগুলোতে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
আল্লাহর হিকমত হলো, তিনি ঋতুগুলোর পরিবর্তন ধীরে ধীরে করেন। যদি তীব্র তাপ হঠাৎ ঠান্ডায় বা ঠান্ডা হঠাৎ তাপে রূপান্তরিত হতো, তবে তা মানুষ ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর হতো।
অনেকে গরমে বরফঠান্ডা পানি পান করেন বা শীতে অতিরিক্ত গরমের ব্যবস্থা করেন, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ইবনে জাওযি (রহ.) এমন একজন শাসকের কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি অতিরিক্ত তাপ ও শীত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করেন এবং অকালে মৃত্যুবরণ করেন।
আল্লাহর হিকমত হলো, তিনি ঋতুগুলোর পরিবর্তন ধীরে ধীরে করেন। যদি তীব্র তাপ হঠাৎ ঠান্ডায় বা ঠান্ডা হঠাৎ তাপে রূপান্তরিত হতো, তবে তা মানুষ ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর হতো। এই ধীর পরিবর্তন আল্লাহর করুণার প্রমাণ।
গ্রীষ্মের তীব্র তাপ আমাদের জাহান্নামের আগুনের কথা স্মরণ করায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘জাহান্নাম তার প্রভুর কাছে অভিযোগ করে বলল, “আমার এক অংশ আরেক অংশকে গ্রাস করছে।” তাই আল্লাহ তাকে দুটি নিশ্বাসের অনুমতি দিলেন: একটি শীতে, আরেকটি গ্রীষ্মে। তাই গ্রীষ্মের তীব্র তাপ জাহান্নামের তাপ থেকে আসে।’
হাসান বাসরি (রহ.) বলেন, ‘যে তাপ বা শীত কিছু ধ্বংস করে, তা জাহান্নামের নিশ্বাস।’
মহানবী (সা.) গরমকালের তীব্র তাপ মোকাবিলার জন্য কিছু ব্যবহারিক পদ্ধতি শিখিয়েছেন, যা আমাদের জন্য আদর্শ। এগুলো হলো:
১. মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালা
তিনি তীব্র তাপ ও তৃষ্ণায়, বিশেষ করে রোজা রাখার সময়, মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালতেন। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে আরজ–এ দেখেছি, তিনি তৃষ্ণা বা তাপের কারণে মাথায় পানি ঢালছেন।’ ইবন উমর (রা.) রোজা রাখা অবস্থায় ভেজা কাপড় ব্যবহার করতেন, আর আনাস (রা.) বলেন, ‘আমার একটি ছোট পানির পাত্র আছে, যেখানে আমি রোজা রাখা অবস্থায় ডুব দিই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯২৮; মুসনাদ আহমদ, হাদিস: ২,৫৬৪)
এটি প্রমাণ করে যে রোজার সময়ও ঠান্ডা পানি দিয়ে শরীর ঠান্ডা করা জায়েজ।
যখন তীব্র তাপ হয়, তখন নামাজ ঠান্ডা সময়ে পড়, কারণ তীব্র তাপ জাহান্নামের নিঃশ্বাস থেকে আসে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৩৬
২. ছায়ায় থাকা
মহানবী (সা.) তীব্র তাপে রোদে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ছায়ায় থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সহিহ বুখারিতে জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) একজন ব্যক্তিকে (আবু ইসরাইল) দেখেন, যিনি মানত করেছিলেন রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন, বসবেন না, ছায়ায় যাবেন না এবং কথা বলবেন না।
তিনি তাকে বললেন, ‘তাকে বলো, কথা বলুক, ছায়ায় যাক, বসুক, তবে তার রোজা পূর্ণ করুক (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৬১৪)।’ তিনি আরো বলেন, ‘যদি কেউ ছায়ায় থাকে এবং ছায়া সরে যায়, যার ফলে তার শরীরের একাংশ রোদে ও একাংশ ছায়ায় থাকে, তবে সে উঠে যাক।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,৩৮৪)
কেননা, এটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত।
৩. জোহরের নামাজে ‘ইবরাদ’
ইবরাদ মানে জোহরের নামাজ তীব্র তাপ কমে গেলে পড়া। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন তীব্র তাপ হয়, তখন নামাজ ঠান্ডা সময়ে পড়, কারণ তীব্র তাপ জাহান্নামের নিঃশ্বাস থেকে আসে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৩৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬১৫)
এটা বিশেষ করে অত্যন্ত গরম অঞ্চলে প্রযোজ্য, যেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদে এটি কম প্রাসঙ্গিক। তবে মসজিদে যাতায়াতকারীদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে এ সময় সামান্য দেরিতে নামাজ পড়া ভালো।
৪. কায়লুলা
কায়লুলা হলো দুপুরের সময় সংক্ষিপ্ত ঘুম। আবু নুয়াইমের বর্ণনায় আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেন, ‘কায়লুলা করো, কারণ শয়তান কায়লুলা করে না।’ (আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা, আবু নুয়াইম)
এতে গরমকালে তাপের মধ্যেও শরীরকে সতেজ থাকে।
৫. গোসল ও সুগন্ধি ব্যবহার
গ্রীষ্মের তাপে ঘাম ও দুর্গন্ধ এড়াতে মহানবী (সা.) গোসল ও সুগন্ধি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘একদিন তীব্র গরমে মানুষ উলের পোশাক পরে মসজিদে এসেছিল। ঘামের দুর্গন্ধে একে অপরকে কষ্ট দিচ্ছিল। মহানবী (সা.) বললেন, “হে লোকেরা, এই দিনে (জুমার দিন) গোসল করো এবং তোমাদের সেরা তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার করো।”’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩৫৩)
এরপর মানুষ উলের পরিবর্তে হালকা পোশাক পরা শুরু করে এবং মসজিদের পরিবেশ উন্নত হয়।
একদিন তীব্র গরমে মানুষ উলের পোশাক পরে মসজিদে এসেছিল। ঘামের দুর্গন্ধে একে অপরকে কষ্ট দিচ্ছিল। মহানবী (সা.) বললেন, “জুমার দিন গোসল করো এবং তোমাদের সেরা তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার করো।”
৬. ঠান্ডা খাবার ও পানীয়
মহানবী (সা.) ঠান্ডা ও মিষ্টি পানীয় পছন্দ করতেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সবচেয়ে উত্তম পানীয় হলো মিষ্টি ও ঠান্ডা।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৮৯৫)
ইমাম মুনাভি বলেন, ‘এটি তাপ কমায়, শরীরের জন্য উপকারী ও কৃতজ্ঞতার উদ্রেক করে।’ মহানবী (সা.) মধুমিশ্রিত ঠান্ডা পানি, খেজুর বা কিশমিশ ভেজানো পানি এবং ঠান্ডা দুধ পান করতেন। ইবনুল কাইয়িম বলেন, মধুমিশ্রিত ঠান্ডা পানি কফ দূর করে, পাকস্থলী পরিষ্কার করে এবং শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে। (জাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়িম)
৭. পানি পান করানো
মহানবী (সা.) পানি পান করানোকে সর্বোত্তম সদকা বলেছেন। সা’দ (রা.) মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন সদকা আপনার কাছে প্রিয়?’ তিনি বললেন, ‘পানি।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১,৬৮১)
বুখারি শরিফে পানি পানি করানোর ফজিলতের ওপর একটি অধ্যায় রয়েছে। রাস্তায় ও মসজিদের সামনে পানির ব্যবস্থা করা হলে এই সুন্নাহ বাস্তবায়ন করা হবে।
মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ গ্রীষ্মের তাপ মোকাবিলার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে, আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করে গ্রীষ্মের তাপের মধ্যেও সুস্থ থাকা যায়। তাঁর এই পথনির্দেশ আজও আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক, যা আমাদের শেখায় প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করতে।