জীবন এমন এক যাত্রাপথ, যেখানে অপ্রত্যাশিত মোড় বা মোড় পরিবর্তন স্বাভাবিক ঘটনা। কখনো কখনো আমরা এমন এক গোলকধাঁধার সামনে এসে দাঁড়াই, যখন মনে হয়, কোথাও কোনো পথ নেই। হয়তো কর্মজীবনের কঠিন চৌরাস্তা, হয়তো ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা, অথবা কোনো এক অনিশ্চয়তা—সবকিছু মিলে এক গভীর হতাশা গ্রাস করে।
কিন্তু ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, জীবনের এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো পরিষ্কার নিয়ত বা উদ্দেশ্য।
কখনো আমরা এমন এক গোলকধাঁধার এসে দাঁড়াই, যেন কোথাও কোনো পথ নেই। কিন্তু ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, এ–সময় সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো পরিষ্কার নিয়ত।
ধরুন, এক পুরোনো বন্ধুর সাথে কথা হল, যিনি জীবনের এমনই এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে যুক্তরাজ্যে একটি শীর্ষস্থানীয় অ্যাকাউন্টিং ফার্মের আরামদায়ক চাকরি ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যের অফিসে যোগদান করবেন।
পেশাগত সুবিধার বাইরেও তার কিছু চমৎকার নিয়ত আছে, হজ পালন করা, মক্কা ও মদিনার কাছাকাছি থাকা, তার পরিবারকে আরও ইসলামি পরিবেশে স্থানান্তর করা এবং তার প্রবীণ বাবা-মাকে কাছে এনে তাঁদরে সঙ্গে সময় কাটানো।
এই পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনে তাঁর প্রধান নিয়ত হজ পালন করা। আর হজ অনেক কল্যাণ নিয়ে আসে। আল্লাহ হয়তো তাঁর জন্য আরো অপ্রত্যাশিত দরজা খুলে দেবেন।
তবে মনে রাখতে হবে, যখন আপনার একটি স্পষ্ট, আল্লাহ-কেন্দ্রিক নিয়ত থাকে, তখন সেটি আপনার জীবন থেকে সমস্ত অসুবিধা দূর করে না, বরং সেই অসুবিধাগুলি কীভাবে অতিক্রম করতে হবে তার একটি কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক আপনাকে দেয়।
আমরা সবাই একটি মৌলিক হাদিস সম্পর্কে জানি, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজের ভিত্তি, “নিশ্চয়ই আমল (কর্ম) সমূহ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল, আর প্রতিটি মানুষ তা-ই পাবে, যা সে নিয়ত করে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)
এই হাদিসটি শুধু আমাদের কর্মের বিচারই করে না, বরং এটি আমাদের জীবনের সংগ্রামেও একটি গভীর ভূমিকা রাখে। আমরা শিখেছি যে নিয়ত আমাদেরকে সেই অবিচলতা ও শক্তি যোগায়, যা সেই কাজগুলি করার সময় অনিবার্যভাবে আসা চ্যালেঞ্জগুলির মধ্য দিয়ে আমাদের টিকে থাকতে সাহায্য করে।
বাহ্যিক কর্ম যত মহৎই হোক না কেন, যদি তার পেছনে উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টির বদলে জাগতিক প্রশংসা বা স্বার্থ হয়, তবে তা মূল্যহীন হয়ে যায়।ইমাম গাজালি (রহ.), ইহয়াউ উলুম আল-দীন
হতে পারে আপনার সেই বন্ধুটি মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে এক টক্সিক বস পেলেন, যা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। সে আর পুরাতন চাকরিতেও ফিরে যেতে পারছে না, এটাও রাখতে পারছে না। হতে পারে সবকিছুই একটি পরীক্ষার অংশ। আল্লাহ তার আন্তরিকতা পরীক্ষা করছেন: কঠিন সময়ে সে কি তার উদ্দেশ্য নিয়ে অবিচল থাকবে, নাকি প্রথম সমস্যা দেখেই সে তার নিয়ত থেকে সরে আসবে?
যদি আপনি বর্তমানে কোনো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তা কর্মজীবনের মোড় হোক, সম্পর্কের চ্যালেঞ্জ হোক, বা ভবিষ্যতের পদক্ষেপ নিয়ে দ্বিধা হোক, তবে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ১. এখানে আমার সত্যিকারের উদ্দেশ্য কী? ২. আমি কীভাবে এই উদ্দেশ্যকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি?
হতে পারে বন্ধুকে তার অফিসের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। তার টক্সিক বস রাতারাতি একজন উষ্ণ বন্ধুতে রূপান্তরিত হবে না। অফিসের পলিটিক্স জাদুবলে উধাও হবে না। কিন্তু যখন সে একটি আল্লাহ-কেন্দ্রিক নিয়ত দ্বারা চালিত হবে, তখন তার দৈনন্দিন কাজের ধরনে একটি পরিবর্তন আসতে পারে।
সে হয়তো আর জিজ্ঞেস করবে না, “কেন এমনটা আমার সাথে ঘটছে?" বরং সে জিজ্ঞেস করবে, "এই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমি কীভাবে আল্লাহর দাসত্ব করতে পারি?”
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মুমিনদেরকে সব সময় ভালো কাজে নিয়তকে খাঁটি রাখার এবং ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা নামাজ আদায় করো এবং জাকাত প্রদান করো; আর রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ৪৩)
নামাজের মতো ইবাদতেও নিয়ত অপরিহার্য। এটি কেবল শারীরিক নড়াচড়া নয়, বরং আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজের সর্বস্ব সমর্পণের মানসিক প্রতিজ্ঞা। তেমনি, জীবনের প্রতিটি কাজে নিয়তের এই স্বচ্ছতা আবশ্যক।
প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম গাজালি (র.) নিয়তকে জীবনের ভিত্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন যে সমস্ত কর্মের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে নিয়তের সত্যতা এবং আন্তরিকতার ওপর। অর্থাৎ, বাহ্যিক কর্ম যত মহৎই হোক না কেন, যদি তার পেছনে উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টির বদলে জাগতিক প্রশংসা বা স্বার্থ হয়, তবে তা মূল্যহীন হয়ে যায়। (ইহয়াউ উলুম আল-দীন, ৪/৭৬-৮১, দার আল-মাআরিফ, বৈরুত, ২০০৬)
কিবলা যেমন নামাজে দিকভ্রান্ত হতে দেয় না, তেমনি জীবনের জটিল পথে আপনার আন্তরিক নিয়ত আপনাকে দিকভ্রান্ত হতে দেবে না।
যখন জীবন আপনাকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, তখন শুধু তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানের দিকে মনোযোগ দেবেন না। এক ধাপ পিছিয়ে যান এবং আপনার গভীরতম নিয়ত বা উদ্দেশ্যের সঙ্গে নিজেকে আবার সংযুক্ত করুন।
এই নিয়তকে আপনার কিবলা (নামাজের দিক) হতে দিন—যা আপনার জীবনের উদ্দেশ্যকে নির্দেশ করবে। কিবলা যেমন নামাজে দিকভ্রান্ত হতে দেয় না, তেমনি জীবনের জটিল পথে আপনার আন্তরিক নিয়ত আপনাকে দিকভ্রান্ত হতে দেবে না।
ইসলামি নীতিশাস্ত্রে উদ্দেশ্যকে সবসময় তিনটি মূলনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়:
১. ইখলাস: উদ্দেশ্য হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
২. সঠিকতা : উদ্দেশ্য হতে হবে শরীয়াহসম্মত।
৩. ইস্তিকামাহ (অবিচলতা): কঠিন পরিস্থিতিতেও নিয়তের ওপর স্থির থাকা।
সুতরাং, যখনই আমরা কোনো কঠিন পরিস্থিতি বা জীবনের মোড়ের সামনে দাঁড়াই, তখন এই তিনটি মূলনীতির আলোকে নিজের নিয়তকে যাচাই করা উচিত। যদি আমাদের নিয়ত আল্লাহর জন্য আন্তরিক হয় এবং আমরা অবিচল থাকি, তবে আমাদের জীবন হয়তো সহজ হবে না, কিন্তু আমাদের হৃদয় শান্ত ও স্থির থাকবে।
আল্লাহ আমাদের আন্তরিক নিয়ত এবং আমাদের সামনে আসা বাধা সত্ত্বেও সেই উদ্দেশ্যগুলি অনুসরণ করার শক্তি দান করুন। আমিন।