ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃত্যু মানেই সবকিছুর শেষ নয়, বরং এক জগত থেকে অন্য জগতে গমনের একটি মাধ্যম মাত্র। মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের পক্ষ থেকে উপহার পাঠানোর সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হলো ‘দোয়া’।
মহানবী (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে বিচ্ছেদের যাতনাকে দোয়ায় রূপান্তর করে একজন মৃত মানুষের পাথেয় বৃদ্ধি করা যায়।
সাধারণত মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার আমলনামা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ দয়ায় কিছু আমল রয়েছে, যা কবরে থাকা মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে থাকে।
এই বিষয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি আমল ব্যতীত; সদকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৬৩১)
এই হাদিসটি প্রমাণ করে যে, একজন সৎ সন্তানের প্রার্থনা মৃত পিতার বা মাতার কবরের আজাব লাঘব করতে বা জান্নাতের মাকাম বৃদ্ধি করতে সরাসরি ভূমিকা রাখে।
মৃত ব্যক্তিকে সমাহিত করার পরপরই তার জন্য দোয়া করা সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। এটি মৃত ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত নাজুক সময়, কারণ তখন তাকে কবরের সওয়াল-জবাবের সম্মুখীন হতে হয়। এই সময়ে জীবিতদের উপস্থিতি ও প্রার্থনা তাকে স্থির থাকতে সাহায্য করে।
ওসমান ইবনে আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, ‘নবীজি (সা.) মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর সেখানে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তার দৃঢ়তার জন্য দোয়া করো, কারণ এই মুহূর্তে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৩,২২১)
দাফনের পর এই সংক্ষিপ্ত অবস্থান ও দোয়া মৃত ব্যক্তির জন্য এক বিশাল প্রশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি আমল ব্যতীত; সদকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৬৩১
মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময়ে জানাজা ও পরবর্তী সময়ে মৃতদের জন্য অত্যন্ত অর্থবহ দোয়া করেছেন। এই দোয়াগুলো কেবল আরবি শব্দ নয়, এর প্রতিটি চরণে রয়েছে মহান রবের কাছে করুণ আর্তি। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবু দাউদ সুলাইমান তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে এমনই কিছু দোয়ার সংকলন করেছেন।
একটি দীর্ঘ ও সুপ্রসিদ্ধ দোয়া হলো,
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মাগফির লাহু ওয়ারহামহু, ওয়া আ-ফিহি ওয়াফু আনহু, ওয়া আকরিমা নুযুলাহু, ওয়া ওয়াসসি’ মাদখালাহু, ওয়াগসিলহু বিল মায়ি ওয়াস সালজি ওয়াল বারাদ...’
যার অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন, তাকে দয়া করুন, তাকে নিরাপত্তা দিন, তাকে মার্জনা করুন, তার মেহমানদারিকে মর্যাদাপূর্ণ করুন, তার কবরকে প্রশস্ত করুন, তাকে পানি, বরফ ও তুষার দিয়ে ধুয়ে দিন এবং তাকে গুনাহ থেকে এমনভাবে পরিষ্কার করুন যেমন সাদা কাপড় ময়লা থেকে পরিষ্কার করা হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৬৩)
এই দোয়ায় একজন মানুষের জান্নাত লাভের এবং কবরের আজাব থেকে মুক্তির সবকটি আর্জি অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
আবার যারা জানাজায় উপস্থিত থাকেন, তারা সকল জীবিত ও মৃত মুসলিমের জন্য এভাবে দোয়া করতে পারেন: ‘হে আল্লাহ! আমাদের জীবিত ও মৃত, উপস্থিত ও অনুপস্থিত, ছোট ও বড় এবং আমাদের নারী-পুরুষ সকলকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে আপনি যাকে জীবিত রাখেন তাকে ইসলামের ওপর জীবিত রাখুন এবং যাকে মৃত্যু দান করেন তাকে ইমানের ওপর মৃত্যু দান করুন।’ (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৪৯৮)
মৃত ব্যক্তি যদি শিশু হয়, তবে তার জন্য দোয়া করার পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন। শিশু নিষ্পাপ হওয়ায় তার জন্য মাগফিরাত নয়, বরং তাকে পিতা-মাতার জন্য সুপারিশকারী ও পরকালীন পাথেয় হিসেবে কবুল করার প্রার্থনা করা হয়। শিশুর ক্ষেত্রে বলা উচিত, ‘হে আল্লাহ, আপনি একে এর পিতা-মাতার জন্য অগ্রগামী পাথেয় এবং সওয়াব ও উপকারের মাধ্যম হিসেবে কবুল করুন।’ (বায়হাকি, হাদিস: ৬৫৮৪)।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অন্য কেউ দোয়া করলে মৃত ব্যক্তির কী লাভ? পবিত্র কোরআনে এর উত্তর দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা পরবর্তী প্রজন্মের মুমিনদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আর যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের এবং আমাদের সেইসব ভাইকে ক্ষমা করুন যারা আমাদের আগে ইমান এনেছে।’ (সুরা হাশর, আয়াত: ১০)
এই আয়াতটিই প্রমাণ করে যে পূর্বসূরিদের জন্য উত্তরসূরিদের প্রার্থনা কেবল বৈধই নয়, বরং প্রশংসনীয়।
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম তাঁর বিখ্যাত ‘কিতাবুর রূহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মৃত ব্যক্তির জন্য উপহার হিসেবে দোয়ার চেয়ে উত্তম কিছু নেই। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, কবরে যখন মৃত ব্যক্তিকে কোনো নেক দোয়ার সওয়াব পৌঁছানো হয়, তখন সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়, যেমন দুনিয়ায় কেউ কোনো মূল্যবান উপহার পেলে আনন্দিত হয়। (কিতাবুর রূহ, ১/১৪৩, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৭৫)
পত্রিকার পাতায় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকবার্তার চেয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য নির্জনে দুই হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলা অনেক বেশি কার্যকর।
দোয়া ছাড়াও যা মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছায় দোয়া তো বটেই, দোয়ার পাশাপাশি আরও কিছু নেক আমল আছে যা মৃত ব্যক্তির উপকারে আসে:
সদকা: মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দান-সদকা করা। জনৈক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার মা হঠাৎ মারা গেছেন, আমার মনে হয় তিনি কথা বলতে পারলে সদকা করতেন। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে সদকা করলে তিনি সওয়াব পাবেন? রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ’। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,৩৮৮)
হজ ও ওমরাহ: যদি মৃত ব্যক্তি সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও হজ না করে থাকেন, তবে তাঁর পক্ষ থেকে বদলি হজ বা ওমরাহ করা যায়। তবে শর্ত হলো, যিনি হজ করবেন তাঁকে আগে নিজের ফরজ হজ সম্পন্ন করতে হবে। (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ১,৮১১)
ঋণ পরিশোধ: এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঋণের দায়ভার নিয়ে মৃত্যুবরণকারীর জানাজা পড়তে দ্বিধা করতেন। তিনি বলেছেন, ‘মুমিনের আত্মা তার ঋণের সঙ্গে ঝুলন্ত থাকে যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা হয়।’ (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ১,০৭৮)
তাই দোয়া করার আগে বা দোয়ার পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করা উত্তরাধিকারীদের প্রধান দায়িত্ব।
স্মৃতি সততই মধুর ও বেদনার। প্রিয়জনকে হারিয়ে আমরা অনেক সময় কেবল কান্নাকাটি বা আনুষ্ঠানিক শোক পালনেই সীমাবদ্ধ থাকি। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হলো, বিলাপ নয় বরং প্রার্থনা।
মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা মানে তাকে ভুলে না যাওয়া। এটি কেবল মৃত ব্যক্তির জন্যই উপকারী নয়, বরং এটি একজন জীবিত মানুষকেও পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তাকে বিনয়ী করে তোলে।
পত্রিকার পাতায় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকবার্তার চেয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য নির্জনে দুই হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলা অনেক বেশি কার্যকর।
প্রতিটি সিজদায়, প্রতিটি নামাজের শেষে যদি আমরা আমাদের চলে যাওয়া বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ও মুসলিম উম্মাহর জন্য ক্ষমা চাই, তবেই আমাদের ভালোবাসা সার্থকতা পাবে। আমাদের এই প্রার্থনাই একদিন আমাদের নিজেদের জন্য পাথেয় হয়ে দাঁড়াবে যখন আমরাও সেই অজানা জগতের বাসিন্দা হবো।