মানুষের জ্ঞান যতই বিস্তৃত হোক না কেন, আকাশ-সমুদ্রের অনেক গোপন রহস্য আমাদের অজানাই থেকে যায়। ইসলামের অন্যতম অলৌকিক ঘটনা মিরাজ, যেখানে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) রাতের অল্প সময়ের মধ্যে সাত আসমান অতিক্রম করে আরশের নিকটে পৌঁছে যান। এই সফরের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো ‘সিদরাতুল মুনতাহা’—যা নিয়ে কোরআন ও সহিহ হাদিসে বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
কী সেই সিদরাতুল মুনতাহা? কেন এটিকে এত তাৎপর্যপূর্ণ বলা হয়?
সুরা আন-নাজমে সিদরাতুল মুনতাহার উল্লেখ এসেছে— “তারপর তিনি ‘সিদরাতুল মুনতাহা’র নিকটে পৌঁছালেন। এর কাছে আছে জান্নাতুল মাওয়া। যখন সেই বৃক্ষকে আচ্ছন্ন করেছিল যা আচ্ছন্ন করেছিল। তখন নবীর দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি, সীমা অতিক্রমও করেনি। তিনি দেখেছেন তাঁর প্রতিপালকের মহান নিদর্শনসমূহ।” (সুরা নাজম, আয়াত: ১৪–১৮)
এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—নবীজি জিবরাইল (আ.)-কে তাঁর প্রকৃত রূপে দেখেছিলেন এবং পৌঁছেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহায়। (তাফসীর ইবনে কাসীর, দারুস সালাম, রিয়াদ: ২০০৩, খণ্ড ৭, পৃ. ৪৬৫)
‘সিদরাহ’ অর্থ কুল বা বরই গাছ আর ‘মুনতাহা’ অর্থ চূড়ান্ত সীমা। অর্থাৎ সিদরাতুল মুনতাহা হলো এমন একটি বিশেষ বরই গাছ, যা সপ্তম আকাশের শেষ সীমায় অবস্থিত।
এটিকে বলা হয় সৃষ্টিজগতের শেষ সীমা। এর পর আর কোনো ফেরেশতা বা সৃষ্টির পদক্ষেপ নেই। কেবল আল্লাহর অনুমতিতেই প্রিয় নবী (সা.) সেই সীমা অতিক্রম করেছিলেন।
সহিহ বুখারির বর্ণনায় নবীজি বলেন, “আমি সিদরাতুল মুনতাহার কাছে গিয়েছিলাম, যা কিছু আচ্ছন্ন করেছিল জানি না। সেখানে সোনার প্রজাপতির মতো কিছু ছিল।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৪৯৩)
সহিহ মুসলিমেও এসেছে, “সিদরাতুল মুনতাহার পাতা হাতির কান সমান, আর এর ফল ছিল বড় বড় কুমড়ার মতো।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৪)
এই বর্ণনা আমাদের ধারণা দেয় যে, এটি ছিল অলৌকিক এক বৃক্ষ, যা পার্থিব কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়।
১. ফেরেশতাদের সীমা: তাফসীরকার ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন—সিদরাতুল মুনতাহা হলো ফেরেশতাদের জ্ঞান ও দায়িত্বের শেষ সীমা। এর পর কী আছে তা কেবল আল্লাহ জানেন।
২. নবীজির বিশেষ মর্যাদা: প্রিয় নবীজিকে এই সীমার পরেও নেয়া হয়েছিল। এখানেই নবীজি (সা.) পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের নির্দেশ পান, যা পরে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয়।
৩. জান্নাতুল মাওয়ার সান্নিধ্য: কোরআনে বলা হয়েছে—সিদরাতুল মুনতাহার কাছেই জান্নাতুল মাওয়া অবস্থিত। এটি সেই জান্নাত যেখানে শহীদ ও নেককার বান্দারা আশ্রয় পাবে। (তাফসীর আত-তাবারী, দারুল মাআরিফ, কায়রো: ১৯৯৯, খণ্ড ২৭, পৃ. ৭৬)
১. বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা: আমরা যত উন্নত হই, কিছু বিষয় আল্লাহর জ্ঞান ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়।
২. নবীজির মর্যাদা: সিদরাতুল মুনতাহা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নবীজি আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় বান্দা।
৩. আমাদের কর্তব্য: মিরাজের উপহার হলো নামাজ। তাই সিদরাতুল মুনতাহার শিক্ষা হলো—নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা।
অনেক আলেম বলেন—সিদরাতুল মুনতাহা শুধু একটি গাছ নয়, বরং এটি হলো জ্ঞান ও সৃষ্টির সীমান্তরেখা। মানুষের ও ফেরেশতাদের বোধগম্যতা এখানে শেষ হয়, আর এর পর শুরু হয় কেবল আল্লাহর বিশেষ জ্ঞানের জগৎ।
আধ্যাত্মিক দিক থেকে বলা যায়, এটি এমন এক স্থান যেখানে সীমিতের সাথে অসীমের মিলন ঘটে।