নহরে জুবাইদা
নহরে জুবাইদা

মক্কার খাবার পানির সমস্যা দূর করেছিল নহরে জুবাইদা

মক্কায় গেলে আরাফাতে বা মিনায় উঁচু নালার মতো কিছু প্রাচীর দেখা যায়। প্রাচীরগুলো বেশ পুরোনো, কিন্তু সংস্কার করা হয়নি। মিনা-মুজদালিফা রেললাইন করার সময়ও নালার প্রাচীর ভাঙা পড়েছে। এই প্রাচীরগুলো হলো নহরে জুবাইদার নালার প্রাচীর।

সেই সময় মক্কায় জমজম ছাড়া পানির তেমন উৎস ছিল না, ফলে হজযাত্রীদের কষ্ট হতো। খলিফা হারুনুর রশিদের আমলে পানির অভাব এত তীব্র হয়ে ওঠে যে, এক বালতি পানি বিক্রি হয় ২০ দিরহামে। ১৯৩ হিজরিতে খলিফার মৃত্যুর পর রানি জুবাইদা হজপালন করতে মক্কা যান। পানির সমস্যা দেখে তিনি একটি খাল কাটার সিদ্ধান্ত নেন। তার নাম হয় ‘নহরে জুবাইদা’ বা রানি জুবায়দার পানির জলধারা। এই নহরের পানি সরবরাহের মধ্য দিয়ে হজযাত্রী ও মক্কা এলাকার খাবার পানির সমস্যামুক্ত হয়। ৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত নহরে জুবাইদা খননে খরচ হয় আনুমানিক ১৭ লাখ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। তখন খাল খননের আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। হাজার বছরব্যাপী এ খালটি জনমানুষের সেবা করেছে।

নহরে জুবাইদার রুট
ছবি: আরব নিউজ

মক্কা উপত্যকার আশপাশে কিছু কূপ থাকলেও পানির উপযুক্ত দুটি উৎস পাওয়া যায়। মক্কার ৩৫ কিলোমিটার দূরে হুনাইন এলাকা অন্যটি আরাফাহ। প্রচলিত আছে, জুবাইদা ওই দুটি অঞ্চল কিনে নিয়েছিলেন। খাল কাটার জন্য সমগ্র এলাকা জরিপ করা হয়। জরিপের পর প্রকৌশলীরা সিদ্ধান্ত দেন হুনায়ন-পবিত্র মক্কা ও তায়েফের পাহাড়ি এলাকা ঝরনা, যা সেখানকার লোকজনের পানীয় জল, সেচের পানির প্রয়োজন মেটাত, সেখান থেকে খাল কেটে আনা হবে। এই অঞ্চল কঙ্করময়, অনুর্বর ও শুষ্ক। আবহাওয়াও উষ্ণ। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয় কোদাল এবং শাবলের প্রতিটি আঘাতের জন্য আমি এক দিরদাম (রৌপ্যমুদ্রা) অর্থ পরিশোধ করব।’ বহু বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে এই নহর আরাফাতে নিয়ে আসা হয়, সেখান থেকে মুজদালিফা ও মিনায় আনা হয়।

নহরের একটি শাখা ওয়াদি নোমান থেকে আরাফাত ময়দান এবং অপর শাখা হুনাইন থেকে মক্কা পর্যন্ত খনন করা হয়। পানির সহজলভ্যতা এবং এ খালের রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি ৫০ মিটার অন্তর একটি করে কূপ খনন করা হয়। আশপাশের ছোট ছোট পানির উৎসকে এ খালের সঙ্গে যুক্ত করে পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা হয়। পানি যাতে সুপেয় হয়, তাই সমুদ্র বাদ দিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ি ঝরনা ও প্রাকৃতিক উৎস থেকে সেই পানি নহরে প্রবাহিত করা হয়। এতে হাজিদের পাশাপাশি কৃষকদের কষ্টও লাঘব হয়। আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা ও মিনার পাশ দিয়ে প্রবাহিত সেই নহরের স্মৃতিচিহ্ন দেখা যায়।

নহরে জুবাইদা
নহরে জুবাইদা

সেকালে মরুভূমিতে যাতায়াত ছিল দুঃসাধ্য। আধুনিক প্রকৌশল বিদ্যা ছাড়াই রানি জুবাইদা কুফা থেকে মক্কা ও মদিনা পর্যন্ত মরুভূমির ওপর ১,৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করেন। ‘নহরে জুবাইদা’ ছাড়াও তিনি মক্কায় আরও ৫টি জলাধার ও অনেক অজুখানা নির্মাণ করেন।

আব্বাসীয় শাসকেরা বাগদাদের সঙ্গে মক্কা মদিনার নগরীর যাতায়াতের জন্য রাস্তা সংস্কার, মঞ্জিলে নানা সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে অর্থ ব্যয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রাচীনকালে দিনে বিশ্রাম, রাতে যাতায়াতের প্রচলন ছিল। সাধারণ নিয়মে এক রাতে ১৬ মাইল পর্যন্ত যাওয়া যেত।

১৬ মাইল পর বিশ্রাম অবস্থানকে বলা হতো মঞ্জিল। রানি জুবাইদা বাগদাদ থেকে পবিত্র এই দুই নগরীতে যাওয়ার মঞ্জিলগুলোর সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। সঙ্গে উট, গাধা, ঘোড়া যাতায়াতে সুবিধার জন্য সমতলে বালু সরিয়ে এবং পাহাড়-পর্বত কেটে সড়ক সংস্কার করেন।

১৪৯ হিজরিতে ইরাকের মসুলেজুবাইদা জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম আমাতুল আজিজ। বেড়ে ওঠেন দাদা খলিফা আবুজাফর মানসুরের প্রাসাদে। ১৬৫ হিজরিতে খলিফা হারুনুররশীদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। রানি জুবাইদা ছিলেন যেকোনো ভালো কাজে আগ্রহী। তিনি প্রচুর দান করতেন। কোরআন তিলাওয়াতের জন্য রাজপ্রাসাদে তিনি ১০০ জন নারী হাফেজ রেখেছিলেন।