বিধান

ইজমা: ইসলামি আইনের অন্যতম ‘দলিল’

ইসলামি শরিয়তের ভিত্তি কোরআন ও সুন্নাহ। কিন্তু এর পরে আসে ইজমা, অর্থাৎ, উম্মাহর ঐকমত্য। ইসলামি আইন বা ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে ইজমার প্রামাণিক মর্যাদা কোরআন ও সুন্নাহর পরেই।

যদিও শিয়া ও মুতাজিলা সম্প্রদায় ইজমার দলিল হওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলেছে, কিন্তু তাদের কথাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলা হয়। ইজমা কোরআন-সুন্নাহ থেকে উদ্ভূত একটা অনুসরণীয় দলিল।

কেউ যদি ইজমার দলিলে রাজি না হয়, তবুও শরিয়তের প্রয়োজনে তা মানতে হবে। যেমন, এক আল্লাহর ইবাদত, রাসুল-ফেরেশতায় ইমান আনা—এগুলো ইমানের বিষয়ে ইজমা। নামাজ, সামর্থ্যবানের হজ—এগুলো ফিকহের বাস্তব ইজমা।

ইজমা উম্মাহর প্রতিনিধিত্ব করে। আলেম, নেতা, চিন্তাবিদ, শিক্ষিত, সাধারণ মুসলিম সবার মিলিত মতই ইজমা। ফিকহে মতভেদকেও ইজমা বলে মানা হয়। হ্যাঁ, মতভেদের স্বীকৃতি নিজেই একটা ইজমা। উম্মাহ সাধারণভাবে ইজমা মান্য করে থাকে, তাই এক-দুজনের বিরোধিতা এর প্রামাণিক মর্যাদায় কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি করবে না। (ইবনে মুনযির, আল-ইজমা, পৃষ্ঠা ১৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৯)

ইজমা কেন দলিল?

কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি রাসুলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের পথ বাদ দিয়ে অন্য পথ অনুসরণ করে, তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সুরা নিসা, আয়াত: ১১৫)

এখানে ‘মুমিনদের পথ’ বলতে ইজমাকেই বোঝানো হয়েছে বলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেমরা একমত। (ইমাম শাফেয়ী, আর-রিসালা, পৃষ্ঠা ৪৬৮-৪৭২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ২০০৫)

হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, “আমার উম্মত কখনো ভ্রষ্টতার ওপর একমত হবে না।” এ হাদিসটি ইজমাকে স্বতন্ত্র দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। (ইবনে তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া, ১৯/২৬২, দারুল ওয়াফা, মানসুরা, ২০০৫)

ইজমার প্রকার

ইজমা দুই প্রকার:

১. প্রয়োজনীয় ও অকাট্য ইজমা—যা উম্মাহর জন্য অপরিহার্য। যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ, রমজানের রোজা, জাকাতের নেসাব, হজের ফরজ হওয়া, মদ্যপান, ব্যভিচার, চুরির শাস্তি ইত্যাদি। এসব বিষয়ে ইজমা অস্বীকার করলে তা ‘কুফর’ হয়।

২. উম্মাহর কষ্ট দূর করার মতো ইজমা। যেমন: খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি, তারাবিহ নামাজের জামাত ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে কিছু মাসআলায় মতভেদ থাকলেও সেগুলোর অনুমোদনযোগ্যতা ইজমার মাধ্যমে হয়। এসব বিষয়ে ইজমা অস্বীকার করলে পাপী (ফাসেক) হবে, কাফির হবে না। (আত-তাওফি, শারহু মুখতাসারির রাওদা, ৩/৪৫৬, মুয়াসসাতুর রিসালাহ, বৈরুত, ১৯৯৭)

ইবনে হাজম (রহ.) বলেন, ইজমা দাবি করা যাবে মূলত দুই জায়গায়:

ক) সাহাবিগণের ইজমা, যারা সবাই সহিহ সনদে জেনে মেনে নিয়েছেন।

খ) যার বিরোধিতা কুফর—যেমন এক আল্লাহর ইবাদত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা, জাকাত, হজ, শরাব-জিনা-চুরির হদ, মৃত পশু ও শূকর হারাম ইত্যাদি। (ইবনে হাজম, আল-মুহাল্লা বিল আসার, ৪/৫০৩-৫০৫, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

কাদের ইজমা গণ্য করা হয়?

শুধু মুজতাহিদ আলেমদের ঐকমত্যই শরিয়ত–মতে ইজমা হিসেবে গণ্য হবে। সাধারণ মানুষের মত গণ্য করা হয় না। (ইমাম গাজ্জালী, আল-মুসতাসফা, ১/১৭৫-১৮০, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৭)

ঐতিহাসিক কয়েকটি ইজমা

আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত নির্বাচন। (ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন, ১/২৪০, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ২০০৩)

  • উসমান (রা.)-এর যুগে কোরআনকে একটি কপিতে সংকলন করা। (আল-জুরকানি, মানাহিলুল ইরফান, ১/২৫০, দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৯৫)

  • উমর (রা.) কর্তৃক তারাবিহ নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়ানো। (ইমাম বুখারি, সহিহ বুখারি, কিতাবুস সালাতিত তারাবিহ)

  • মুরতাদ বা ধর্মদ্রোহীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। (ইবনে কুদামা, আল-মুগনি, ৯/১৮, দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৯৪)

আধুনিক যুগে ইজমা

আজকের যুগে পৃথিবীর সব মুজতাহিদকে একত্র করা অসম্ভব বলে স্পষ্ট ইজমা হওয়া কঠিন। তবে কিছু বিষয়ে এখনো ইজমা রয়েছে—যেমন সুদ হারাম, ধূমপানের নিষিদ্ধতা ইত্যাদি। (শায়খ উসাইমিন, মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ৫/১২-৩০, দারুস সামায়ি, রিয়াদ, ২০১০)

ইজমা হলো উম্মাহর জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নিরাপত্তা-ব্যবস্থা। এটি কোরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা দেয়। যে ব্যক্তি ইজমা অস্বীকার করে, সে আসলে উম্মাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আল্লাহ আমাদের কোরআন, সুন্নাহ ও সালাফে সালেহিনের ঐকমত্যের ওঅটল রাখুন। আমিন।